ব্যুরো নিউজ, ৩১শে ডিসেম্বর ২০২৫ : শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা কেবল একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি জীবন পরিচালনার এক অনন্য আকর। কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তা বর্তমান যুগে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মানসিক চাপ, অবসাদ এবং অশান্তি দূর করতে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ তিনটি বিশেষ মন্দ অভ্যাসের কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলোকে তিনি ‘নরকের দ্বার’ বলে অভিহিত করেছেন।
১. অনিয়ন্ত্রিত কাম বা বাসনা (Lust/Unchecked Desires)
মানুষের ইচ্ছা বা বাসনা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু যখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখনই বিপত্তি ঘটে। আজকের ভোগবাদী সমাজে নতুন গ্যাজেট, বিলাসদ্রব্য বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার অন্ধ দৌড় আমাদের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তুলছে। শ্রীকৃষ্ণের মতে, এই অতি-বাসনা মানুষের বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে দেয়, যার ফলে ব্যক্তি ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য ভুলে গিয়ে নিজের পতন ডেকে আনে।
সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ
২. ক্রোধ: বুদ্ধিনাশের প্রধান কারণ (Anger)
বর্তমান সময়ে তুচ্ছ কারণে বিবাদ বা কলহ আমাদের নিত্যসঙ্গী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সতর্ক করেছেন যে, ক্রোধ মানুষের বিবেক ও বুদ্ধিকে বিনাশ করে। রাগের মাথায় নেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত বা একটি কটু কথা বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা সম্পর্ক বা কঠোর পরিশ্রমকে এক নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে। গীতার শিক্ষা অনুযায়ী, মানসিক প্রশান্তিই পারে এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে।
৩. লোভ: অতৃপ্তির এক অন্তহীন তৃষ্ণা (Greed)
নরকের তৃতীয় দ্বার হলো লোভ। এটিই আজকের সমাজে দুর্নীতি, প্রবঞ্চনা এবং পারিবারিক বিচ্ছেদের মূলে রয়েছে। লোভী ব্যক্তি তার যা আছে তা নিয়ে কখনোই সন্তুষ্ট হতে পারে না; সে সর্বদা আরও পাওয়ার নেশায় মত্ত থাকে। শ্রীকৃষ্ণ লোভকে এমন এক শৃঙ্খল বলেছেন যা আত্মাকে বন্দি করে রাখে এবং প্রকৃত শান্তি অর্জনে বাধা দেয়।
গীতার কোন অংশে এই আলোচনা রয়েছে?
এই গভীর জীবনদর্শন বর্ণিত হয়েছে গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে, যার নাম ‘দৈবাসুরসম্পদ্বিভাগযোগ’। এই অধ্যায়ের ২১ নম্বর শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টভাবে বলেছেন:
“ত্রিবিধং নরকস্যেদ্যং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ। কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতত্রয়ং ত্যজেৎ।।”
সরলার্থ: কাম, ক্রোধ ও লোভ—এই তিনটি হলো নরকের দ্বার, যা আত্মাকে বিনাশ করে। তাই নিজের মঙ্গলের জন্য এই তিনটি দোষ পরিত্যাগ করা একান্ত প্রয়োজন।
মুক্তি ও শান্তির পথ
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বুঝিয়েছিলেন যে, এই তিনটি আসক্তি ত্যাগ করতে পারলে মানুষ নিজের আত্মার কল্যাণ করতে পারে এবং পরম শান্তি ও সুখের অধিকারী হয়। আসলে ‘নরক’ কোনো বাইরের স্থান নয়, বরং আমাদের নেতিবাচক অভ্যাস ও মানসিক বিকারের মধ্যেই তার অবস্থান। এই তিনটি দ্বার রুদ্ধ করতে পারলেই আমরা একটি সুন্দর ও সার্থক জীবন গড়ে তুলতে পারব।



















