ব্যুরো নিউজ ২১ জুন : মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) তাদের প্রোবা-৩ (Proba-3) মিশন চালু করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য হল মহাকাশে কৃত্রিম সূর্যগ্রহণ তৈরি করে সূর্যের করোনা বা বাইরের বায়ুমণ্ডলকে বিশদভাবে অধ্যয়ন করা। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মিশনের দুটি স্যাটেলাইটই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO)-এর রকেট দ্বারা সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। সম্প্রতি, গত ১৬ জুন, ESA কৃত্রিম পূর্ণগ্রাস গ্রহণের ছবি প্রকাশ করে, যা বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করেছে।
পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ কী ভাবে হয়?
সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ যখন তাদের নিরন্তর প্রদক্ষিণের সময় একই সরলরেখায় চলে আসে, তখন সূর্যের আলো চাঁদের দ্বারা আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ হয়। যেহেতু চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছে থাকে, তার ছায়া পৃথিবীর উপর পড়লে সূর্যের কোনো অংশই আর দেখতে পাওয়া যায় না, তখনই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়। এটি একটি বিরল ঘটনা, সাধারণত এক বা দেড় বছরে একবার ঘটে এবং কয়েক মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না।
‘মহাকাশ অভিযানের ৭,২০০টির বেশি পরীক্ষা সম্পন্ন’: ইসরো প্রধান
কী ভাবে কৃত্রিম পূর্ণগ্রাস সম্ভব হল?
ESA-এর প্রোবা-৩ মিশন দুটি পৃথক কিন্তু সমন্বিত স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এই অসাধ্য সাধন করেছে: করোনোগ্রাফ স্পেসক্রাফ্ট (Coronagraph Spacecraft – CSC) এবং অকাল্টার স্পেসক্রাফ্ট (Occulter Spacecraft – OSC)। করোনোগ্রাফ স্পেসক্রাফ্টের ওজন ৩৪০ কেজি এবং অকাল্টার স্পেসক্রাফ্টের ওজন ২০০ কেজি। এই দুটি স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে একটি অত্যন্ত উপবৃত্তাকার কক্ষপথে উড়ছে এবং পরস্পরের থেকে ১৫০ মিটার দূরত্বে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখছে। কৃত্রিম গ্রহণ তৈরি করতে অকাল্টার স্পেসক্রাফ্টে (হালকা স্যাটেলাইট) থাকা একটি প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা চাকতি সূর্যের মাঝের অংশকে ঢেকে দেয়। এর ফলে অকাল্টারের ছায়া করোনোগ্রাফ স্পেসক্রাফ্টে (ভারী স্যাটেলাইট) রাখা যন্ত্রের উপর পড়ে, যার মাধ্যমে কৃত্রিম পূর্ণগ্রাস গ্রহণ চাক্ষুষ করা হয়। অকাল্টার করোনোগ্রাফের সামনে থেকে সূর্যকে ঢেকে রাখে, অর্থাৎ করোনোগ্রাফ অকাল্টারকে অনুসরণ করে। বেলজিয়ামের রয়্যাল অবজ়ারভেটরির প্রধান তদন্তকারী অ্যান্ড্রেই জ়ুকোভ ছবিগুলি দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছেন, “ছবিগুলি দেখে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি। এটাই ছিল আমাদের প্রথম চেষ্টা। প্রথমেই এতটা সাফল্য পাব, ভাবতে পারিনি।”
প্রোবা-৩ অভিযান কী?
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রোবা-৩ অভিযান শুরু করেছিল ESA। করোনোগ্রাফ এবং অকাল্টার স্যাটেলাইটকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পাঠানো হয়েছিল। গত মার্চে এই দুই স্যাটেলাইট নিজেদের মধ্যে ১৫০ মিটার দূরত্ব রেখে পৃথক হয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বেশ কয়েক ঘণ্টা স্যাটেলাইট দুটি পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। সূর্যগ্রহণ তৈরির জন্য অকাল্টার স্যাটেলাইটে যে চাকতিটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা। অকাল্টারের ঠিক পিছনে ১৫০ মিটার দূরে ছিল করোনোগ্রাফ। সূর্য ঢাকা পড়ে যাওয়ার পর করোনোগ্রাফের অপটিক্যাল যন্ত্রগুলিতে আট সেন্টিমিটারের ছায়া পড়েছিল, যার ফলস্বরূপ সূর্যের করোনা স্তরের স্পষ্ট চিত্র ধরা পড়ে স্যাটেলাইটের ক্যামেরায়।
প্রাকৃতিক গ্রহণের সাথে তফাৎ
অ্যান্ড্রেই জ়ুকোভ ব্যাখ্যা করেছেন যে, প্রাকৃতিক গ্রহণের ছবির সাথে এই কৃত্রিম গ্রহণের ছবিগুলি তুলনা করা যায়। প্রধান পার্থক্য হল, প্রোবা-৩ অভিযানের মাধ্যমে এই ধরনের গ্রহণ প্রতি ১৯.৬ ঘণ্টা অন্তর একবার করে ঘটানো সম্ভব। যেখানে প্রাকৃতিক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ এক বা দেড় বছরে একবার হয় এবং মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। প্রোবা-৩ অভিযানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অন্তত ছয় ঘণ্টা ধরে পূর্ণগ্রাস গ্রহণ ধরে রাখতে পারবেন, যা দীর্ঘক্ষণ ধরে সূর্যের গ্রহণকালীন অবস্থার পর্যবেক্ষণ সম্ভব করবে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই কৃত্রিম গ্রহণ?
সূর্যের করোনা স্তরটি এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে অনেক রহস্যে ঘেরা। সূর্যের সবচেয়ে বাইরের দিকের অংশ হলেও করোনার তাপমাত্রা সূর্যের কেন্দ্রের চেয়ে বেশি। সাধারণত করোনা স্তরটিকে দেখা যায় না কারণ সূর্যের আলোয় তা ঢেকে থাকে। একমাত্র পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময়েই এই স্তরটি দেখতে পান বিজ্ঞানীরা। করোনার নিরবচ্ছিন্ন এবং বিপুল তাপমাত্রার রহস্য ভেদ করতে প্রোবা-৩ সাহায্য করবে, কারণ এর ফলে দীর্ঘক্ষণ করোনা স্তরটিকে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণা করতে পারবেন। এতদিন এই সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার জন্য পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের অপেক্ষা করতে হত। এছাড়া, করোনা স্তর থেকেই সূর্যের যাবতীয় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হয়, যা করোনাল মাস ইজেকশন (CME) এবং সৌরঝড়ে সৌরজগতের আবহাওয়াকে বিঘ্নিত করে। কখনও কখনও এই ধরনের তেজস্ক্রিয় কণা পৃথিবীর দিকেও ছুটে আসে, যার ফলে বিদ্যুৎ সঙ্কট, নেটওয়ার্ক এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে। কৃত্রিম উপগ্রহের কাজও সৌরঝড়ে ব্যাহত হয়। এই সৌরবাতাসের পর্যবেক্ষণে কৃত্রিম গ্রহণ অত্যন্ত কাজে লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
স্টারলিঙ্কের ভূপতনে মাস্কের স্বপ্ন চূর্ণ ? যা ঘটেছে !!!
ইসরো-র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
এই মিশনের উৎক্ষেপণে ইসরো (ISRO)-এর ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। প্রোবা-৩ স্যাটেলাইটগুলি ২০২৪ সালের ৫ই ডিসেম্বর শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে ইসরো-র পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (PSLV-C59) দ্বারা সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এটি ছিল নিউস্পেস ইন্ডিয়া লিমিটেড (NSIL)-এর একটি নিবেদিত বাণিজ্যিক মিশন। উল্লেখ্য যে, এর আগেও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা তাদের প্রোবা সিরিজের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য ইসরো-র সাহায্য নিয়েছিল। প্রোবা-১ (Proba-1) স্যাটেলাইটটি ২০০১ সালের ২২শে অক্টোবর ইসরো-র PSLV-C3 রকেট ব্যবহার করে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এই মিশনে ESA দ্বারা ISRO-কে সরবরাহ করা স্যাটেলাইট এবং রিয়েল-টাইম অটোমেশন বা ট্র্যাকিংয়ের ডেটা ISRO-কে তাদের নিজস্ব সৌরগ্রহণ মিশনগুলির জন্য ডেটা মডেল তৈরি করতে সহায়তা করবে। বিশেষ করে, ভারতের সৌর গবেষণার জন্য প্রথম উৎসর্গীকৃত মিশন আদিত্য-L1 (Aditya-L1) এর প্রেক্ষিতে এই তথ্য অত্যন্ত মূল্যবান হবে, যা সূর্যের করোনা এবং সৌর কার্যকলাপ সম্পর্কে ভারতের নিজস্ব গবেষণাকে আরও উন্নত করবে।