সৌরদীপ চ্যাটার্জ্জী, ১ মেঃ (Latest News)  কলকাতা হাইকোর্ট দেশের প্রাচীনতম হাইকোর্ট। ১৮৬২ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পরে তার প্রতিষ্ঠা। বহু খ্যাতনামা বিচারপতি এখানে কাজ করেছেন। কিন্তু হঠাৎ এখন যদি একেবারে ছাপোষা আইনকানুনের সঙ্গে দূরদূরান্তের সম্পর্ক নেই, এমন কাউকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, “জাস্টিস গাঙ্গুলি আর জাস্টিস মান্থা ছাড়া কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নাম বলতে পারবেন? নতুন বা পুরনো?” কতজন তাদের নাম বলতে পারবেন, সন্দেহ রয়েছে।

খুব ভেবেচিন্তে ক্যুইজ-ট্যুইজ করা কেউ হলে হয়ত প্রথম প্রধান বিচারপতি স্যার বার্নস পিকক  নামটা বলে দেবেন। কেউ হয়ত মাথা চুলকে-টুলকে চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, কুলদাচরণ দাশগুপ্ত, পিনাকীচন্দ্র ঘোষ কিংবা দীপঙ্কর দত্তের নাম বললেও বলতে পারেন। তার বাইরে?

এই যে বিচারপতিদের লোকসমক্ষে না আসা, এই ব্যাপারটা কিন্তু খুব সচেতনভাবে মেনে চলা হয়। একজন বিচারপতি যখন তাঁর এজলাসে বলেন, তখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কোন মত প্রকাশ করেন না। কারণ তাঁর মত মানে সেটা আদালতের মত। সংবিধান এবং আইন সকলের জন্যই সমান। অথচ এই সমষ্টিগত ব্যাপারটা সবসময় এক থাকে না।

প্রায়ই দেখা যায়, সিঙ্গল বেঞ্চের রায় ডিভিশন বেঞ্চে খারিজ হয়ে যাচ্ছে। কখন আবার দেখা যায় এক বিচারপতির মতের সঙ্গে অন্যকোন বিচারপতির মত মেলে না। বলা যেতে পারে এটা ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় একটা খামতি। অর্থাৎ নিজেই নিজের সমালোচক।

সুপ্রিম কোর্ট চাইলে তার নিজের দেওয়া রায়কেও বাতিল করে দিতে পারে। বিচারপতি আদালতে বসে যা বলবেন সেটাই তাঁর জবাব।  তার বাইরে সংবাদমাধ্যমে অন্তত অবসরের আগে কিছু বলার তাঁর থাকতে পারে না। এরকম কোনো নিয়ম নেই।  এরকমটাই হয়ে আসছে। এরকম আরও অনেক কিছুই আদালতের ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। “যেমন দীর্ঘসূত্রিতা”।

কথাতেই আছে, “কোর্টকাছারির চক্করে যাস না বাবা, জীবন চলে যাবে!” বাস্তবে ঘটেও তাই। বছরের পর বছর ঝুলে থাকে মামলা । ওকালতির সঙ্গে যুক্ত কোন ব্যাক্তিকে একটু ভীতির সঙ্গেই তাই দেখা হয়। “ উকিলে ছুঁলে কত ঘা”-  ইত্যাদিও বলা হয়।  তার কারণ উকিলের যুক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। কখন কোন কেস দিয়ে দেবে তা কেউ জানে না। সরকারি তথ্য বলছে, দেশের মোট বন্দির মামলার ৭০% এখনও বিচারাধীন। নিতান্ত বাধ্য না হলে বা খুঁটির জোর না থাকলে কেউ চট করে আদালতের দ্বারস্থ হননা। আমজনতার বেশিরভাগই কোর্টের ঝামেলা এড়িয়ে চলেন।

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিষয়টিকে এইগুলোর পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে। তাঁর কাজ করার মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে,তা হল-

প্রথম বৈশিষ্ট্য- এই দীর্ঘসূত্রিতার বিরুদ্ধতা। তাঁর নির্দেশে একেবারে সময় বেঁধে দেওয়া থাকে। যে সময়ের মধ্যে অভিজুক্তকে হাজির করার নির্দেশ থাকে সেই সময়ের মধ্যেই অভিজুক্তকে হাজির করতে হবে। নির্ধারিত দিনের মধ্যেই সিবিআইকে মামলা শুরু করতে হবে।

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- কড়া হুকুম। এমন একজনকে আমরা দেখছি যার কথাই একেবারে হেডমাস্টারের মত, ছাত্রদের কানে গেলেই ভয়ে কাঁপবে।

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য- চটজলদি সমাধান। কয়েক দশক ধরে বেতন না পাওয়া কেউ তাঁর কাছে আসতেই কয়েক ঘন্টায় কড়া হুকুম চলে যায়, অবিলম্বে বেতন মিটিয়ে দিতে হবে। নিম্ন আদালতে একটি মাতৃহারা বালকের প্রাপ্তি সংক্রান্ত মামলা ঝুলে আছে জেনেই সটান নিজের মোবাইল থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলার বিচারককে ফোন করে বসলেন তিনি। তাঁর এক ফোনেই কাজ হয়ে গেল। অর্থাৎ, আমজনতাকে ঠিক যে যে কারণে ভুগতে হয় তার গোড়াতেই তিনি বদল আনতে চাইছেন। গোটা হাইকোর্টের ইতিহাসে বোধহয় এমন ঘটনা কেউ দেখেনি।

দূর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর কড়া পদক্ষেপ তো এখন  প্রায় রোজই কাগজের হেডলাইন। এমন অনমনীয় মেজাজে দূর্নীতির কেস সামলানোর নজিরও আর কারও নেই। কিন্তু অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তার আসল কারণ তাঁর নেওয়া চটজলদি পদক্ষেপ। প্রতিটি রায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সময় বেঁধে দেওয়া, তীব্র বকাবকি।  রাজ্যের এসএসসি থেকে শুরু করে সিবিআই,  ছাড় নেই কারোরই।

আদালতে যেতে মানুষের যে যে কারণে ভয়, যেন তার সবকটাই ভাঙানোর দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। একেবারে ধরে ধরে মানুষের সেই ভয় বা ভীতি কিংবা অনাস্থার জায়গাগুলোতে হাত দিচ্ছেন তিনি। কাজও হচ্ছে তেমনই। এটাই তাঁর জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি।

এই সময় দারিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দেড়শো বছরের ইতিহাসে সম্ভবত তিনিই একমাত্র বিচারপতি, যার নামে জয়ধ্বনি ওঠে। যাকে সামনে পেলে “স্যার আপনিই ভগবান” বলেই লোকে তাঁর হাঁটা পথের ধুলোয় মাথা ঠোকে।

বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সাক্ষাৎকার দিয়ে ভুল করেছেন কিনা, সেই বিচার সুপ্রিম কোর্ট করেছেন।সে বিচার করবার সাধ্যও আমাদের নেই, নেই যোগ্যতাও।

বিচারপতিদের হতে হবে আবেগবর্জিত, যুক্তিনিষ্ঠ, নীরস এবং নিরপেক্ষ। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সম্ভবত এই মাপকাঠিতেই আলাদা। তিনি তাঁর ব্যাক্তিগত জীবনে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ একজন মানুষ। তবে সেটা তাঁর দুর্বলতা নয়। সেটাই সম্ভবত তাঁর শক্তি। এই শক্তিই তাঁকে কলকাতা হাইকোর্টের দেড়শো বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে পাকাপাকিভাবে জুড়ে রাখবে। (EVM News)

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর