ব্যুরো নিউজ, ৩০শে ডিসেম্বর ২০২৫ : শ্রীরামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া যখন দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছে, তখন রামরাজ্যের বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়ান এক রাজা, যিনি ছিলেন মহাদেবের পরম ভক্ত। তাঁর ভক্তির টানেই স্বয়ং শিব সেই রাজাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। অন্যদিকে, সেই যজ্ঞের অশ্ব রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন শ্রীরামের অনুজ শত্রুঘ্ন এবং রাম-প্রাণ হনুমান। এই পরিস্থিতি এক অদ্ভুত সংকটের সৃষ্টি করে—একদিকে রামের ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার সংকল্প, অন্যদিকে ভক্তের প্রতি শিবের বাৎসল্য।
১. শ্রদ্ধা ও কর্তব্যের অন্তর্ঘাত
হনুমান যখন মহাদেবকে তাঁর পথে অন্তরায় হিসেবে দেখলেন, তখন তাঁর মনে কোনো ক্রোধ বা বিদ্রোহ ছিল না। ছিল এক অসহ্য অন্তর্বেদনা। হনুমানের কাছে রামের সেবা কোনো পছন্দ বা অপছন্দের বিষয় নয়, তা তাঁর অস্তিত্ব। আবার মহাদেব স্বয়ং তাঁর আরাধ্য। কিন্তু যখন মহাদেব সেই রাজাকে রক্ষা করতে তলোয়ার তুলে নিলেন, হনুমান পিছু হঠলেন না। এই লড়াই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ছিল না; এটি ছিল নিজের সত্যের প্রতি অটল থাকার লড়াই।
২. শিব যখন সীমানা, হনুমান তখন গতি
শিব এই কাহিনীতে ধ্বংসকারী নন, তিনি এক অলঙ্ঘনীয় সীমানা। তিনি স্থিরতার প্রতীক, যিনি গতিরোধ করেন। অন্যদিকে হনুমান হলেন নিরন্তর গতি এবং সংকল্পের মূর্ত রূপ। যখন এই দুই মহাজাগতিক শক্তি মুখোমুখি হয়, তখন সৃষ্টি হয় এক গভীর দার্শনিক ঘাত-প্রতিঘাতের। হনুমান জানতেন, আজ যদি তিনি মাথা নত করেন, তবে তা কেবল পরাজয় হবে না, বরং রামের চরণে তাঁর যে দায়িত্ব, তার অবমাননা হবে।
Hanumanji : কেন সরল ও অনাড়ম্বর ভক্তরাই হনুমানজির সবচেয়ে কাছের?
৩. ব্রহ্মাস্ত্র ও পাশুপত অস্ত্র: হনুমানের অদ্ভুত আত্মসংযম
যুদ্ধের তীব্রতা যখন চরম সীমায় পৌঁছালো, শত্রুঘ্ন নিরুপায় হয়ে মহাদেবের ওপর ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ নিক্ষেপ করলেন। পালটা জবাবে শিবও তাঁর প্রলয়ংকর ‘পাশুপত অস্ত্র’ প্রয়োগ করলেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যখন এই দুই মহাজাগতিক অস্ত্রের সংঘর্ষে ধ্বংস হওয়ার অপেক্ষায়, তখনই দেখা গেল হনুমানের অকল্পনীয় আত্মত্যাগ।
তিনি কোনো পাল্টা আক্রমণ করলেন না। তিনি কেবল দুই অস্ত্রের মাঝখানে নিজের বিশাল শরীর ও হৃদয়কে মেলে ধরলেন। তিনি ব্রহ্মার শক্তি এবং শিবের তেজ—উভয়কেই নিজের মধ্যে শোষণ করে নিলেন। তিনি চাইলেন না এই সংঘাতে শিবের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হোক, আবার চাইলেন না রামের কার্য বিঘ্নিত হোক। এই সংযমই প্রমাণ করে যে প্রকৃত শক্তি আস্ফালনে নয়, বরং ধারণ করার ক্ষমতায়।
৪. পরাজয় নয়, বরং এক দিব্য স্বীকৃতি
যখন হনুমান শান্তভাবে সেই প্রচণ্ড তেজ গ্রহণ করলেন, মহাদেব তাঁর অস্ত্র সংবরণ করলেন। সেখানে কোনো অহংকার ছিল না, ছিল এক গভীর নীরবতা। শিব বুঝতে পারলেন, হনুমানের ভক্তি অন্ধ নয়; তা সচেতন এবং দায়িত্ববোধে সিক্ত। শিবের সেই পিছু হটা কোনো হার নয়, বরং হনুমানের অবিচল নিষ্ঠার প্রতি এক পরম স্বীকৃতি।
Hanumanji : যন্ত্রণাই আমন্ত্রণ: হনুমানের অপ্রকাশিত উপস্থিতির গোপন রহস্য
৫. এই কাহিনী আমাদের যা শেখায়
“ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ”—আমরা যখন ধর্মকে রক্ষা করি, তখন ধর্ম আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু এই রক্ষা করার পথ সবসময় শান্ত বা সহজ হয় না। অনেক সময় আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বা শ্রদ্ধেয় শক্তির সামনেও নিজের কর্তব্যের খাতিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। হনুমান আমাদের শেখালেন যে, ভক্তি মানে কেবল নত হওয়া নয়, ভক্তি মানে সত্যের প্রয়োজনে পাহাড়ের মতো অবিচল থাকা।
উপসংহার
হনুমান ও শিবের এই যুদ্ধ আমাদের শেখায় যে জীবন সবসময় সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে চলে না। মাঝে মাঝে শ্রেষ্ঠ নীতিবোধের মধ্যেই সংঘাত তৈরি হয়। সেই মুহূর্তে নিজের ভেতরের রাম বা নিজের আত্মসত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকাই হলো প্রকৃত ধর্ম।



















