ব্যুরো নিউজ, ১৭ই ডিসেম্বর ২০২৫ : হিন্দু ধর্মে কোনো কিছুই আকস্মিক বা অর্থহীন নয়। বিঘ্নহর্তা গণেশের বিশাল দেহের পাশে ক্ষুদ্র এক ইঁদুরকে দেখে প্রথম দর্শনে কৌতুক মনে হতে পারে, কিন্তু এই সংযোগের গভীরে লুকিয়ে আছে জীবন, আকাঙ্ক্ষা এবং বিনয়ের এক অতুলনীয় শিক্ষা। ‘গণেশ পুরাণ’ অনুযায়ী, এই মূষিক কেবল একটি বাহন নয়, সে আমাদের আত্মার এক নীরব শিক্ষক।
১. বিনয়ই প্রকৃত শক্তি
আকার বা আয়তন দিয়ে মহত্ত্ব বিচার করা যায় না। ইঁদুর অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং চঞ্চল এক প্রাণী, তবুও সে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি গণেশকে বহন করে। ‘মৎস্য পুরাণ’-এ বর্ণিত হয়েছে যে, মূষিক স্বভাবত অস্থির হলেও তার দেবত্ব ও একাগ্রতা তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এটি আমাদের শেখায় যে, সার্থকতা অর্জনের জন্য গর্জনের প্রয়োজন নেই; বরং বিনম্রভাবে নিজের লক্ষ্য ও কর্তব্যের প্রতি অবিচল থাকাই হলো প্রকৃত শক্তি।
২. বাসনার ওপর নিয়ন্ত্রণ
হিন্দু দর্শনে বাসনা বা কামকে বর্জন করতে বলা হয়নি, বরং তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে। ইঁদুর যেমন কৌতূহলী এবং সর্বদা কিছু না কিছু অন্বেষণ করে, আমাদের মনও ঠিক তেমন। গণেশের পদতলে ইঁদুরের অবস্থান প্রতীকীভাবে আমাদের জানায় যে, যখন চঞ্চল আকাঙ্ক্ষা বুদ্ধির (গণেশ) দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন তা জীবনের পথে বাধা না হয়ে বরং সহায়ক হয়ে ওঠে। আপনার ইচ্ছাগুলোকে দমন করবেন না, বরং সেগুলোকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।
Ganeshji : গণেশ উপাখ্যান: বাধা মোচনের দেবতা ও তাঁর ঐশ্বরিক শিক্ষা
৩. শক্তির চেয়ে কৌশলের গুরুত্ব
বিশাল শক্তি দিয়ে যা সম্ভব নয়, অনেক সময় ক্ষুদ্রতা ও ধৈর্য দিয়ে তা সম্ভব হয়। একটি ইঁদুর অত্যন্ত সংকীর্ণ গর্ত দিয়ে যাতায়াত করতে পারে, যেখানে বড় কোনো প্রাণীর প্রবেশ অসম্ভব। এটি জীবনের এক বড় শিক্ষা—সব সমস্যার সমাধান পেশিবহুল শক্তি বা জোরালো প্রতিক্রিয়ায় হয় না। অনেক সময় ধৈর্য, কৌশল এবং পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা (Adaptability) আমাদের বড় জয় এনে দেয়।
৪. ক্ষুদ্র কাজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব
আমরা মনে করি বড় কোনো পরিবর্তন আনতে হলে বিশাল কিছু করতে হবে। কিন্তু শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার কর্মযোগের দর্শনের মতো এই মূষিক আমাদের শেখায় যে, প্রতিটি ছোট কিন্তু সচেতন কর্ম আমাদের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে। আপনার ক্ষুদ্র একটি শুভ কাজ বা সচেতন সিদ্ধান্ত এক বিশাল ইতিবাচক তরঙ্গের সৃষ্টি করতে পারে। জীবনের নকশা তৈরি হয় অসংখ্য ছোট ছোট সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে।
Ganeshji : সিদ্ধিদাতার মহিমা: গণেশ দেবের দশটি পবিত্র নামের গভীর তাৎপর্য
৫. উত্তরণ ও শুদ্ধিকরণ
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এই মূষিক এককালে একজন অভিশপ্ত দেব সত্তা ছিলেন, যিনি ভক্তি ও সেবার মাধ্যমে মুক্তি খুঁজে পান। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অতীত যাই হোক না কেন, আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং ধর্মের পথে চলার সংকল্প থাকলে যেকোনো ভুল সংশোধন করে জীবনের পূর্ণতা অর্জন সম্ভব। অস্থিরতা থেকে স্থিরতায় আসার সুযোগ সবার জন্যই উন্মুক্ত।
উপসংহার
গণেশের বাহন মূষিক আমাদের আয়নার মতো। এটি আমাদের ভেতরের সেই চঞ্চল মনকে তুলে ধরে যা বুদ্ধির সংস্পর্শে এলে এক বিশাল শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়ায়। যে পৃথিবী আজ কেবল বাহ্যিক জাঁকজমক আর গতির পেছনে ছুটছে, সেখানে এই ছোট্ট প্রাণীটি আমাদের শেখায় একটু থামতে, নিবিষ্ট হতে এবং জীবনের অতি সূক্ষ্ম পাঠগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করতে।

















