lord hanuman in twin epics

ব্যুরো নিউজ, ০৯ই ডিসেম্বর ২০২৫ : যখনই আমরা ভগবান হনুমানের কথা ভাবি, তখনই তাঁর ভক্তিময় রূপটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে – যেখানে তিনি নিজের বুক চিরে রাম ও সীতাকে হৃদয়ে ধারণ করে আছেন। তিনি আনুগত্য, শক্তি এবং অবিচল ভক্তির মূর্ত প্রতীক। যদিও তাঁকে মূলত রামায়ণের সঙ্গেই যুক্ত করা হয় এবং আমরা মনে করি তিনি শুধু ত্রেতা যুগেরই বীর, কিন্তু এই ধারণাটি অনেক সময় ভুল প্রমাণিত হয়। হনুমান কেবল ত্রেতা যুগের নায়ক নন, তাঁর উত্তরাধিকার, তাঁর উপস্থিতি এবং তাঁর পূজা দ্বাপর যুগ অর্থাৎ মহাভারতের যুগেও বিদ্যমান।

তাহলে কেন হনুমান এই দুটি মহাকাব্য জুড়েই পূজিত হন? কী কারণে তিনি সময়, যুগ এবং প্রেক্ষাপটকে অতিক্রম করে আজও প্রাসঙ্গিক? চলুন, এই কালজয়ী ভক্তির রহস্য উন্মোচন করা যাক।

রামায়ণে হনুমান: অতুলনীয় ভক্ত

হনুমানের শাশ্বত প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে হলে, প্রথমেই রামায়ণে তাঁর ভূমিকা আলোচনা করা প্রয়োজন। অঞ্জনা ও বায়ুদেবতার পুত্র হনুমান, জন্ম থেকেই স্বর্গীয় শক্তিসম্পন্ন এক বানর রূপে বেড়ে ওঠেন। তাঁর শৈশবের দুষ্টুমি ও শক্তি কিংবদন্তীতুল্য হলেও, ভগবান রামের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের পরই তাঁর আধ্যাত্মিক পরিচয় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

হনুমান স্বর্গীয় এবং পার্থিব জগতের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করেন। সীতার খোঁজ, লঙ্কাদহন এবং সঞ্জীবনী নিয়ে আসা – এগুলি কেবল বীরত্বপূর্ণ কাজ নয়, এগুলি প্রতীকীও বটে। তিনি বিনয়ে প্রোথিত শক্তি, অনুগ্রহে ব্যবহৃত ক্ষমতা এবং অহংকারমুক্ত ভক্তির প্রতীক।

Hanumanji : হনুমান চালিশা: ৪০ দিনের অভ্যাসে মন ও আত্মার রূপান্তর

ভক্তি যা বীরত্বের সংজ্ঞা বদলে দেয়

রামায়ণের যুগে হনুমানের পূজা তাঁর ভক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি কোনো পুরস্কার চাননি, কোনো পদমর্যাদার আকাঙ্ক্ষা করেননি। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল রামের সেবা করা। এই নিঃস্বার্থ, বিশুদ্ধ এবং নির্ভীক ভক্তি ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে সকলের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এই কারণেই হনুমান কেবল একটি গল্পের চরিত্র নন, তিনি একটি জীবন্ত আদর্শ।

তিনি এই ধারণার প্রতিনিধিত্ব করেন যে, ঈশ্বরের সেবা করাই শক্তির সর্বোচ্চ রূপ। আর এই কারণেই, রামের পার্থিব জীবন শেষ হওয়ার পরেও হনুমানের প্রাসঙ্গিকতা ম্লান হয়নি। তাঁর যাত্রা রামায়ণের সঙ্গেই শেষ হয়নি – বরং তা প্রসারিত হয়েছে।

মহাভারতে হনুমান: এক লুকানো সাক্ষী

এবার বিষয়টি আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। মহাভারত, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি যুগ ও কাহিনি। অথচ, সেখানেও হনুমানের আবির্ভাব ঘটে – তবে যুদ্ধের বীর হিসেবে নয়, এক নীরব আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে।

একবার পাণ্ডব ভাইদের অন্যতম ভীম (যিনি বায়ুদেবতার পুত্রও বটে) দ্রৌপদীর জন্য একটি দিব্য ফুল খুঁজতে গিয়েছিলেন। পথে তিনি এক বৃদ্ধ বানরকে শুয়ে থাকতে দেখেন। বিরক্ত হয়ে ভীম ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বানরটিকে পথ থেকে সরে যেতে বলেন। বানরটি দুর্বলতার অজুহাত দেখিয়ে ভীমকে তার লেজ সরাতে বলে। ভীম চেষ্টা করেন – কিন্তু ব্যর্থ হন।

তখনই সেই বানর তার আসল রূপ প্রকাশ করেন: তিনি স্বয়ং হনুমান, জন্মসূত্রে ভীমের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।

এই ঘটনাটি কেবল বিনয়ের একটি শিক্ষাই নয়, এটি প্রমাণ করে – হনুমান উভয় যুগেই বিদ্যমান। তিনি সময়ের দ্বারা আবদ্ধ নন। আর আধ্যাত্মিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হলেই তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন।

অর্জুনের রথে: হনুমানের প্রতিশ্রুতি

মহাভারতের সঙ্গে হনুমানের সবচেয়ে প্রতীকী যোগসূত্রটি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় আসে। যুদ্ধ শুরুর আগে অর্জুন তাঁর রথের শক্তি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। ভগবান কৃষ্ণ, তাঁর সারথি, তাঁকে হনুমানকে আহ্বান করার পরামর্শ দেন।

আর সেই কারণেই, হনুমান অর্জুনের রথের ধ্বজায় (পতাকায়) স্থান গ্রহণ করেন। এটি শুধু মনোবল বাড়ানোর জন্য ছিল না। প্রতীকীভাবে, হনুমান অটল শক্তি, আধ্যাত্মিক সুরক্ষা এবং ঐশ্বরিক উপস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর ধ্বজা বহন করার কারণে অর্জুনের রথ যুদ্ধের সময় অক্ষত ছিল – এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হনুমান চলে যাওয়ার পরেই রথটি অবশেষে জ্বলে ওঠে।

এমনকি নীরবতার মধ্যেও, হনুমান ছিলেন রক্ষাকর্তা।

হনুমান: চিরঞ্জীবী

হনুমান উভয় যুগে পূজিত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো তাঁর চিরঞ্জীবী অবস্থা। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, ভগবান রাম হনুমানকে অমরত্ব দান করেছিলেন, যাতে তিনি প্রতিটি যুগে ভক্তি ও ধার্মিকতা ছড়িয়ে দিতে পারেন।

এর অর্থ হল, হনুমান কোনো “অতীতের” দেবতা নন। তাঁর ভক্তদের কাছে, তিনি আজও বর্তমান – শুনছেন, দেখছেন, পথ দেখাচ্ছেন। বেনারসের মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি থেকে শুরু করে বটগাছের নিচে ছোট মন্দির পর্যন্ত, হনুমান সকলের কাছেই সহজে উপলব্ধ। মানুষ শুধু তাঁর কাছে প্রার্থনা করে না – তারা তাঁর সাথে কথা বলে।

সকল ঋতু ও সংগ্রামের ঈশ্বর

হনুমানের পূজা কেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে, তা কেবল তাঁর গল্পের কারণে নয় – বরং তিনি বিভিন্ন মানুষের কাছে কীসের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার কারণেও।

যোদ্ধার কাছে: তিনি অহংকারমুক্ত শক্তি। ভক্তের কাছে: তিনি বিশুদ্ধতম ভক্তি। ছাত্রের কাছে: তিনি একাগ্রতা ও শৃঙ্খলা। হৃদয়ভাঙা মানুষের কাছে: তিনি স্থিতিস্থাপকতা ও সান্ত্বনা। বিভ্রান্ত মানুষের কাছে: তিনি স্পষ্টতা।

এই সর্বজনীনতা হনুমানকে কেবল একটি মহাকাব্যের চরিত্র থেকে অনেক বেশি কিছু করে তোলে। তিনি এমন মানুষের জন্য একজন পথপ্রদর্শক, রক্ষক এবং অনুপ্রেরণা, যারা তাদের নিজস্ব যুদ্ধগুলি – আবেগগত, মানসিক বা আধ্যাত্মিক – অতিক্রম করছে।

Hanumanji : মঙ্গলবার কিভাবে হনুমানজিকে অর্পণ করবেন ? জানুন বার উদযাপন পদ্ধতি ।

আধুনিক যুগের ভক্তি: আজও সজীব

মন্দিরগুলিতে হনুমান চালিসা পাঠের ধ্বনি থেকে শুরু করে মঙ্গলবার ব্রত এবং শহরের ওপর সুবিশাল হনুমান মূর্তি পর্যন্ত, হনুমানের পূজা কোনো প্রাচীন ইতিহাস নয় – এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য। এমনকি ক্রীড়াবিদ ও কুস্তিগীররাও তাঁকে শারীরিক দক্ষতা ও মানসিক শক্তির প্রতীক হিসেবে শ্রদ্ধা করেন।

একটি ডিজিটাল যুগে, যেখানে যুক্তি দিয়ে পৌরাণিক কাহিনিকে প্রায়শই একপাশে সরিয়ে দেওয়া হয়, সেখানেও হনুমান কেন প্রাসঙ্গিক, তার একটি কারণ আছে। তাঁকে শুধু পূজা করা হয় না; তাঁর উপর নির্ভর করা হয়।

একজন ভক্ত যিনি দেবতা হলেন

রামায়ণ এবং মহাভারত উভয় যুগেই হনুমানের উপস্থিতি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটি এই স্মারক যে, সত্যিকারের ভক্তি, বিনয় এবং সেবা কালজয়ী গুণ। তিনি কেবল একটি যুগ বা একটি গল্পের অন্তর্ভুক্ত নন – তিনি ভারতের আধ্যাত্মিক ডিএনএ-তে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এবং সম্ভবত, সেই কারণেই হনুমান আজও উচ্চ মস্তকে দাঁড়িয়ে আছেন – শতাব্দী, গল্প এবং সংগ্রাম পেরিয়ে – শুধু একজন দেবতা হিসেবে নয়, একটি শক্তি হিসেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর