ব্যুরো নিউজ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : একটি বিরল এবং অত্যন্ত প্রাণঘাতী মস্তিষ্ক সংক্রমণ, যা ‘মস্তিষ্ক-খেকো’ অ্যামিবা (Naegleria fowleri) দ্বারা সৃষ্ট, এখন দক্ষিণ ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও দেখা যাচ্ছে। কেরালায় এই সংক্রমণ একসময় বিরল হলেও এখন তা মৌসুমী বিপদে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের বাসিন্দা এক ৫৬ বছর বয়সী ব্যক্তির মধ্যে এই রোগের লক্ষণ ধরা পড়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, উষ্ণ, দূষিত বা অপরিশোধিত জলের মাধ্যমে এই অ্যামিবা মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে, যা দ্রুত মস্তিষ্কের টিস্যু নষ্ট করে দেয় এবং এর মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশের বেশি।
শ্রীরামপুরের প্রবীণ কর্মকার: দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থতার পথে
হুগলির শ্রীরামপুরের বাসিন্দা প্রবীণ কর্মকার (৫৬), পেশায় একজন প্লাম্বার, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। গত এপ্রিল মাসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রায়ই জ্ঞান হারাতে শুরু করেন। ঠিকমতো হাঁটাচলাও করতে পারছিলেন না। বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর অবশেষে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি হন। দুই মাস ধরে সেখানে চিকিৎসা চললেও রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছিল না। পরে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁর বিরল ‘মস্তিষ্ক-খেকো’ অ্যামিবা সংক্রমণ ধরা পড়ে।
প্রবীণ কর্মকারের স্ত্রী পম্পা কর্মকার জানান, চিকিৎসকেরা বলেছেন যে দূষিত জল থেকে এই রোগ হয়েছে। যেহেতু প্রবীণবাবু মূলত জল ট্যাঙ্ক পরিষ্কার এবং কলের মেরামতের কাজ করতেন, তাই সম্ভবত সেই সংক্রমিত জল তাঁর শরীরে প্রবেশ করেছিল। তবে বর্তমানে তিনি অনেকটাই সুস্থ, কথাবার্তা এবং চলাফেরা করতে পারছেন।
রোগের কারণ ও সতর্কতা: কেন এটি এত প্রাণঘাতী?
সাধারণত, এই অ্যামিবা উষ্ণ ও অপরিশোধিত মিষ্টি জলের উৎস, যেমন পুকুর, হ্রদ বা নদীর মতো স্থানে বংশবৃদ্ধি করে। নাক দিয়ে এটি মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে ‘প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস’ (PAM) নামক এক ভয়াবহ রোগ সৃষ্টি করে। বিশ্বজুড়ে এর মাত্র কয়েকশ’ কেস নথিভুক্ত হয়েছে, কিন্তু এর মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি।
কেরালার মতো রাজ্যে বহু পুকুর এবং কুয়ো থাকার কারণে মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনে এই জল ব্যবহার করে। সেখানে মানুষ এই জলে স্নান করে, সাঁতার কাটে এবং ধর্মীয় কারণে নাকে জল দেয়, যা সংক্রমণের অসংখ্য প্রবেশপথ তৈরি করে। তবে আশার কথা হলো, কেরালায় জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের কারণে রোগ নির্ণয় এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে, যা বেঁচে থাকার হার কিছুটা হলেও বাড়াচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, রোগের দ্রুত ও আগ্রাসী চিকিৎসা জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে।
Baba Ramdev : ৫০ বছরেও নেই রোগ, চুল নিকশ কালো, জানুন যোগগুরু বাবা রামদেবের তারুণ্যের রহস্য
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং জনসচেতনতা
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডল ও জলের তাপমাত্রা বাড়ছে, যা এই অ্যামিবার প্রজননকালকে দীর্ঘায়িত করছে। কেরালায় যা ঘটছে, তা আসলে একটি বৈশ্বিক প্রবণতার পূর্বলক্ষণ। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে একসময় শুধু গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের এই রোগ এখন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এই ধরনের জলবাহিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গণসচেতনতা অপরিহার্য। মানুষকে নিয়মিত জল সঞ্চয়ের ট্যাঙ্ক পরিষ্কার রাখা, সাঁতার কাটার সময় নাকের প্লাগ ব্যবহার করা এবং স্থির বা দূষিত জল এড়িয়ে চলার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। চিকিৎসকেরা বলছেন, পরীক্ষাগারের সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছ প্রতিবেদন প্রকাশ এবং কমিউনিটি শিক্ষাই এই রোগকে একটি ‘ব্যবস্থাপনাযোগ্য ঝুঁকি’-তে পরিণত করতে পারে।