ব্যুরো নিউজ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : কাতারের রাজধানী দোহায় একটি জরুরি আরব-ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন সম্প্রতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কাতার-এর উপর হামলার তীব্র নিন্দা করেছে। এই নজিরবিহীন ঘটনার প্রতিবাদে আরব লীগ এবং অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন (OIC)-এর প্রায় ৬০টি সদস্য রাষ্ট্র একজোট হয়েছিল, যেখানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার বক্তব্যে কাতারের প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেন এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানান। এই হামলাটি হয়েছিল হামাস নেতাদের একটি বৈঠকের উপর, যা নিয়ে আলোচনা চলছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে।
সম্মেলনে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসি, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা ইসরায়েলের কঠোর সমালোচনা করেন এবং অর্থনৈতিক চাপ, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি একটি যৌথ আরব-ইসলামিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন, যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের অবস্থান তুলে ধরবে।
রাষ্ট্রসংঘে ইসরায়েলের পাল্টা জবাব: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দ্বিচারিতা
দোহা সম্মেলনের পর পরই এই ঐক্যের আহ্বান প্রশ্নের মুখে পড়ে যখন রাষ্ট্রসংঘে ইসরায়েলের প্রতিনিধি পাকিন্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে “দ্বিমুখী নীতি”র অভিযোগ আনেন। রাষ্ট্রসংঘে পাকিস্তানের দূত আসিম ইফতিখার আহমাদ যখন দোহায় ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা করেন, তখন ইসরায়েলের স্থায়ী প্রতিনিধি ড্যানি ড্যানন পাকিস্তানকে পাল্টা আক্রমণ করে বলেন যে, পাকিস্তানের মাটিতেই আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, “যখন বিন লাদেনকে পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছিল, তখন কেউ প্রশ্ন তোলেনি ‘কেন অন্য দেশের মাটিতে একজন সন্ত্রাসীকে লক্ষ্য করা হলো?’ প্রশ্ন ছিল, ‘কেন একজন সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল?’” ড্যানন জোর দিয়ে বলেন, বিন লাদেনের যেমন কোনো দায়মুক্তি ছিল না, তেমনি হামাসেরও থাকতে পারে না।
একইভাবে, জেনেভা-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘ইউএন ওয়াচ’-এর প্রধান হিলেল নিউয়ার রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে কাতারকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, “যদি আপনারা আপনাদের রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লক্ষ্যবস্তু হামলা না চান, তাহলে কেন আপনারা আপনাদের রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেন?” মাত্র সাত সেকেন্ডের একটি ভাইরাল ভিডিওতে তিনি পাকিস্তানকে “সন্ত্রাসবাদের আরেক পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
Leftist Hypocrisy : বামপন্থীদের দ্বিমুখী নীতি: নেপাল ও বাংলাদেশের ঘটনায় আমার ভাবনা
ঐক্য না বিভেদ? পারস্পরিক আক্রমণ ও নীরবতা
দোহা সম্মেলনে আরব-মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের দাবি সত্ত্বেও, তাদের নিজেদের মধ্যেই যে গভীর বিভাজন রয়েছে, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাতেই পাওয়া যায়।
- ইরান-কাতার সম্পর্ক: মাত্র কয়েকমাস আগেই ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর মধ্যপ্রাচ্য কমান্ডকে লক্ষ্য করে কাতারের আল উদাইদ ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। সেই সময় কাতার এই হামলাকে “সার্বভৌমত্বের চরম লঙ্ঘন” বলে অভিহিত করে এবং ইরানি রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রতিবাদ জানায়। দোহা সম্মেলনে যখন কাতার-এর সার্বভৌমত্বের উপর ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করা হচ্ছে, তখন ইরানের এই পূর্ববর্তী হামলাটি এই ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
- সৌদি আরব-ইয়েমেন সংঘাত: এই সম্মেলন চলার সময়ই সৌদি আরবের মদিনায় বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়, যার পেছনে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হাত থাকার সন্দেহ করা হয়। OIC-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সৌদি আরব এই হামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, যা তাদের নিজেদের মধ্যেকার বিভেদকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
এই ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়, আরব ও মুসলিম দেশগুলো প্রকাশ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যতই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলুক না কেন, তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং নিজেদের পছন্দের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার নীতি তাদের ঐক্যকে দুর্বল করে দিয়েছে। তাদের এই দ্বিচারিতা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতাকে গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।