ব্যুরো নিউজ ০৫ জুলাই ২০২৫ : ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসে এমন কিছু চরিত্র আছেন, যাঁদের জীবনগাথা আজও বিস্ময় ও কৌতূহল সৃষ্টি করে। এমনই একজন হলেন বৈশালীর কিংবদন্তী নগরবধূ আম্রপালী। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে একটি আমগাছের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় আবিষ্কৃত এই শিশুকন্যা, যাঁর নামকরণ হয়েছিল ‘আম’ এবং ‘পল্লব’ (কচি পাতা) শব্দদ্বয়ের সংমিশ্রণে ‘আম্রপালী’, কে জানত, একদিন তিনিই হয়ে উঠবেন ইতিহাসের এক অনবদ্য অধ্যায়?
অনিন্দ্য রূপের অধিকারী, নগরবধূ হিসেবে নিযুক্তি
আম্রপালী ছিলেন এক অসাধারণ সুন্দরী এবং অতুলনীয়া নর্তকী। তাঁর রূপের খ্যাতি এতটাই ছিল যে রাজা-মহারাজা থেকে সাধারণ মানুষ—সকলেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। বৈশালীর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁরা আম্রপালীকে কারও ব্যক্তিগত মালিকানায় না রেখে, পুরো নগরের জন্য ‘নগরবধূ’ হিসেবে ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে একজন নারীকে পতিতা হিসেবে নিয়োগ করার এমন নির্মম এবং বিরল উদাহরণ ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়।
এভারেস্টের উচ্চতা প্রথম নিরূপণ করেছিলেন একজন বাঙালি গণিতবিদ
পাঁচটি শর্তে আম্রপালীর সম্মতি: জীবন ছিল তাঁর হাতে
এই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও, আম্রপালী নিজের আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতা বজায় রাখতে পাঁচটি কঠোর শর্তে সম্মতি জানান: ১. তাঁর বাসস্থান হবে নগরের সেরা স্থানে। ২. প্রতি রাতের জন্য মূল্য ধার্য করা হয় ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা। ৩. একবারে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি তাঁর কাছে প্রবেশ করতে পারবেন। ৪. অপরাধী খোঁজার অজুহাতে সপ্তাহে একবারের বেশি তাঁর গৃহে প্রবেশ করা যাবে না। ৫. কে তাঁর কাছে আসল বা গেল, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এই শর্তগুলির মাধ্যমে আম্রপালী যেন নিজের জীবনকে নিজের হাতেই রেখেছিলেন, যা সেই সময়ে একজন নারীর জন্য ছিল এক অসাধারণ পদক্ষেপ।
ক্ষমতা ও প্রেমের টানাপোড়েন: রাজাদের সাথে সম্পর্ক
ধীরে ধীরে আম্রপালী অঢেল ধনসম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। তাঁর রূপের খ্যাতি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি মগধরাজ বিম্বিসারও ছদ্মবেশে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। আম্রপালী প্রথম দেখাতেই রাজাকে চিনতে পারেন এবং তাঁর প্রতি প্রেম নিবেদন করেন। তবে রক্তপাতের আশঙ্কায় তিনি রাজার হতে চাননি। বিম্বিসার ফিরে গেলেও তাঁর পুত্র অজাতশত্রু আম্রপালীর প্রেমে এতটাই মগ্ন হন যে পিতাকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করেন!
উদ্বাস্তু হয়ে সামুদ্রিক যাযাবর ; এক বিরল জনজাতি ‘বাজাও ‘ !
গৌতম বুদ্ধের আগমনে জীবনের মোড় পরিবর্তন
তবে আম্রপালীর জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় মোড়টি আসে যখন গৌতম বুদ্ধ বৈশালীতে আগমন করেন। এক তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে আম্রপালীর মনে গভীর আগ্রহ জন্মায়। তিনি সেই সন্ন্যাসীকে নিজের করে পেতে এবং মুগ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রথমবার তিনি কোনো পুরুষকে নিজের সৌন্দর্যের জাদুতে বশীভূত করতে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতাই আম্রপালীর জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। শেষমেশ, তিনি তাঁর সমস্ত ঐশ্বর্য ও বিলাসী জীবন ত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধের শরণাপন্ন হন এবং একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুণীতে রূপান্তরিত হন। এটি তাঁর জীবনের এক আমূল পরিবর্তন, যা তাঁকে শুধুমাত্র একজন নগরবধূ থেকে আত্মত্যাগ ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক করে তোলে।
‘আম্রপালী’ আম: এক মহীয়সী নারীর স্মৃতিতে নামাঙ্কিত ফল
আজও আমরা যে সুস্বাদু “আম্রপালী” আম মিষ্টির জন্য পছন্দ করি, তার নামকরণ এই মহীয়সী নারীর স্মরণে করা হয়েছে। এই ফলটি কেবল স্বাদে মিষ্টি নয়, এটি ইতিহাসের এক সাহসী নারী, যাঁর জীবন ছিল রূপ, ক্ষমতা, প্রেম, ত্যাগ এবং আত্মবোধের এক জটিল বুনন—তাঁরই অমর স্মৃতির স্মারক। ইতিহাসে তিনি শুধু একজন ‘পতিতা’ রূপে নয়, বরং একজন দৃঢ়চেতা নারী, যাঁর জীবন এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল, সেই প্রতীক হিসেবেই বেঁচে আছেন।