kasba gangrape accused monojit mishra

ব্যুরো নিউজ ৩০ জুন: দক্ষিণ কলকাতার সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজ ক্যাম্পাসে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় রাজ্যজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত প্রাক্তন ছাত্র মনোজিৎ মিশ্র সহ মোট চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মধ্যে কলেজের দুই ছাত্র এবং একজন সিকিউরিটি গার্ডও রয়েছে। মনোজিৎ মিশ্রের অতীত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) সঙ্গে তার কথিত যোগসূত্র নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে, যা এই ঘটনাকে আরও জটিল করে তুলেছে।

অভিযুক্তের অতীত ও টিএমসিপি’র সাথে যোগসূত্র

গণধর্ষণের মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রের প্রাক্তন ব্যাচমেট তিতাস মান্না চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছেন। তিতাস দাবি করেছেন যে তিনি ২০১২ সাল থেকে মনোজিৎকে চিনতেন এবং তারা একসময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। উভয়েই একই কলেজে পড়তেন এবং টিএমসিপি-তে সক্রিয় ছিলেন। তিতাসের অভিযোগ, মনোজিৎ এর আগেও একাধিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। ২০১৩ সালে একটি ঘটনার পর মনোজিৎ কিছুদিনের জন্য আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল, কিন্তু ২০১৬ সালের দিকে আবার কলেজে ফিরে আসে।
তিতাস আরও দাবি করেছেন যে মনোজিতের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে ছাত্র ইউনিয়নের কাজ থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। তবুও মনোজিতের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে তার কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সে শ্লীলতাহানি, হামলা, তোলাবাজির মতো অনেক ঘটনায় জড়িত ছিল, কিন্তু তার প্রভাব এবং পাশে দাঁড়ানোর লোকের কারণে কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে ভয় পেত।

কসবা কলেজে গণধর্ষণ: ধৃত টিএমসিপি সদস্য, বিরোধী দলেনেতার নিশানায় প্রশাসনিক ব্যর্থতা ।

পুরনো এফআইআর এবং কলেজের পরিবেশে আতঙ্ক

তিতাস মান্নার দাবি অনুযায়ী, ছাত্র ইউনিয়নে প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার পর মনোজিৎ কলেজের বাইরেও গুন্ডামি করত। একবার সে নিজেই নিজের মাথা ফাটিয়ে কলেজের দুই জুনিয়রের বিরুদ্ধে মিথ্যা এফআইআর দায়ের করেছিল। কলেজে মনোজিৎ এক ধরনের আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করত, যার কারণে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেত না। তিতাস আরও দাবি করেছেন যে মনোজিৎ একাধিকবার তার বাড়ির নীচে হট্টগোল করেছে এবং মদ্যপান করে মেয়েদের পিজি-তে ঢুকেও হট্টগোল করেছে। ২০২২ সালে কলেজের বাইরে এক ছাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনায় মনোজিতের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল।

ভাইরাল পোস্ট এবং তৃণমূল নেতাদের সাথে ছবি

কসবার আইন কলেজের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর মনোজিৎ মিশ্রের একটি পুরনো ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে, যেখানে সে আরজি কর কাণ্ডের পরে লিখেছিল, “ধর্ষকের ফাঁসি চাই, দোষীদের ফাঁসি চাই, নাটক নয়, বিচার চাই।” এই পোস্টের প্রেক্ষিতে মনোজিতের বর্তমান অপরাধের সাথে তার পূর্বের মন্তব্য বৈপরীত্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
এদিকে, গণধর্ষণে অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রের সঙ্গে একাধিক তৃণমূল নেতার ছবি সামনে এসেছে, যার মধ্যে মন্ত্রী, তৃণমূল বিধায়ক এবং ছাত্র সংগঠনের রাজ্য সভাপতিও রয়েছেন। তার ফেসবুক প্রোফাইলে ‘ল কলেজের TMCP ইউনিটের প্রাক্তন সভাপতি’ লেখা রয়েছে। কলেজ পরিচালন সমিতির সুপারিশে মনোজিৎ মিশ্র এই কলেজেই অস্থায়ী কর্মী হিসেবে চাকরি পেয়েছিল। পাশাপাশি, সে আলিপুর কোর্টেও আইনজীবী হিসেবে প্র্যাক্টিস করত।
যদিও টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য দাবি করেছেন যে মনোজিৎ সংগঠনের কোনো পদে ছিল না। তবে কলেজের অনেকেই জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে কলেজে ভর্তি হলেও মনোজিৎ পাশ করতে পারেনি এবং ডিসকলেজিয়েট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘প্রভাব খাটিয়ে’ সে আবার ছাত্র হিসেবে কলেজে প্রবেশ করে। অভিযোগ, তার বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ দায়ের হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এবং অভিযোগকারীদের শারীরিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। সামগ্রিক ব্যাপারটা পর্যালোচনা করলে তৃনমূল কংগ্রেসের দ্বিচারিতার তথ্য প্রকাশ পায় ।

ভয়ঙ্কর রাতের সিসিটিভি ফুটেজ ও ‘পরিচিত দাদা’র ভূমিকা

পুলিশি তদন্তে সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের সাড়ে ৭ ঘণ্টার সিসিটিভি ফুটেজ হাতে এসেছে। ফুটেজে দেখা গিয়েছে, ঘটনার রাতে আতঙ্কিত অবস্থায় নির্যাতিতা গেটের কাছে আসেন। গেটে তালা দেখে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। তখন দুই অভিযুক্ত তাকে জোর করে টানতে টানতে গার্ড-রুমের দিকে নিয়ে যায় এবং সেখানেই এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে।
পুলিশি জেরায় মনোজিৎ মিশ্র ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। সে জানিয়েছে, “আমার কী ক্ষমতা তা সকলেই জানে। ওই মেয়েটাও জানত। আগে এমন বহু কেস করেছি। কিন্তু মেয়েটা কমপ্লেন করে দেবে ভাবিনি। গুরুত্ব দিইনি।” মনোজিৎ পুলিশকে আরও জানিয়েছে যে সে দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিতাকে সহবাসের প্রস্তাব দিচ্ছিল, কিন্তু সে রাজি না হওয়ায় সে ‘একটা হেস্তনেস্ত’ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
২৫ জুন এই ঘটনা ঘটানোর পর মনোজিৎ তার এক ‘পরিচিত দাদা’-কে ফোন করেছিল, যিনি আগে বহুবার তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তবে এবার সেই ‘দাদা’র কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে মনোজিৎ বুঝতে পারে পরিস্থিতি জটিল। প্রথমে নির্যাতিতাকে ফোন করে শাসানো হয়, যার প্রমাণ পুলিশের হাতে এসেছে। এরপর মনোজিৎ তার দুই শাগরেদ জয়ব এবং প্রমিতকে ধর্ষণের ভিডিও নিজেদের গ্রুপ থেকে ডিলিট করে দিতে নির্দেশ দেয়। তবে শেষরক্ষা হয়নি এবং পুলিশ নির্যাতিতার অভিযোগের ভিত্তিতে মনোজিৎ, জয়ব ও প্রমিতকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্তরা কেউ পালানোর চেষ্টা করেনি। ধারণা করা হচ্ছে, মনোজিৎ তার ‘পরিচিত দাদা’র উপর ভরসা রেখেছিল। সে তার শাগরেদদেরও বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিল, এই আশ্বাস দিয়ে যে ‘সব সামলে নেব’। মনোজিৎ সম্ভবত ভেবেছিল, এবারও এফআইআর হবে না এবং তাকে কেউ ছুঁতেও পারবে না।

ওপার বাংলায় তরুণী ধর্ষণ রাজনৈতিক প্রভাবশালী দ্বারা ! নারী সুরক্ষা এবং সন্মান বিলুপ্তির ছায়া গোটা বাংলায় ।

বিয়ের প্রস্তাব, হুমকির মুখে পরিবার এবং নারী সুরক্ষার প্রশ্ন

অভিযোগপত্রে ছাত্রী আরও দাবি করেছেন যে, তাকে জোর করে কলেজের রুমে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের ঘটনা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা হয় এবং কাউকে জানালে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। জানা গেছে, অভিযুক্ত কলেজের প্রাক্তনী মনোজিৎ মিশ্র ছাত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। রিলেশনশিপে থাকার কারণে ছাত্রী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে, তার প্রেমিককে খুনের হুমকি এবং ছাত্রীর বাবা-মাকে গ্রেফতারের ভয় দেখানো হয়।
এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র (৩১) ছাড়াও কলেজেরই দুই ছাত্র জয়ব আহমেদ ও প্রমিত মুখোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃত তিনজনকে ৪ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গত বছর আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কলকাতার কলেজে এই বর্বরোচিত গণধর্ষণের অভিযোগ রাজ্যে নারী সুরক্ষা নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলেছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর