ব্যুরো নিউজ ২৭ জুন: দক্ষিণ কলকাতার কসবা এলাকার একটি আইন কলেজের অভ্যন্তরে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনা আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুই বর্তমান ছাত্র এবং একজন প্রাক্তন ছাত্র সহ তিনজনকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঘটনার বিবরণ ও পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপ
ঘটনাটি ঘটে গত ২৫শে জুন, বুধবার সন্ধ্যায়, কসবার আইন কলেজের ক্যাম্পাসের ভিতরে, রাত ৭:৩০টা থেকে রাত ৮:৫০-এর মধ্যে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নির্যাতিতা তরুণী সঙ্গে সঙ্গেই কসবা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে কসবা পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং ২৬শে জুন বৃহস্পতিবার রাতে তিন অভিযুক্তকেই হেফাজতে নেয়।
শাসকদলের জয়োল্লাসে নাবালিকার মৃত্যু ; চরম নৈরাজ্যের মর্মান্তিক চিত্র
অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার ও চলমান তদন্ত
সূত্রে খবর, নির্যাতিতার অভিযোগের পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তালবাগান এলাকা থেকে ১৯ বছর বয়সী জায়েব আহমেদ এবং ৩১ বছর বয়সী মনোজিত মিশ্র নামে দুই বর্তমান ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তৃতীয় অভিযুক্ত, ২০ বছর বয়সী প্রমিত মুখোপাধ্যায়কে শুক্রবার ২৭শে জুন ভোরের দিকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রমিত একই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমানে একজন আইনজীবী। গ্রেপ্তারকৃত তিনজনেরই মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সকল অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূল অভিযুক্ত প্রাক্তন ছাত্র বলে মনে করা হচ্ছে এবং বাকি দুজনের জড়িত থাকার মাত্রা নির্ধারণের জন্য তদন্ত চলছে। আজ, শুক্রবার, তিন অভিযুক্তকেই আলিপুর আদালতে হাজির করা হবে এবং ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য কসবা থানার পুলিশ তাদের হেফাজতে চাইবে।
ধৃতদের মধ্যে তৃণমূল ছাত্রনেতা
কসবা আইন কলেজের গণধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত তিন অভিযুক্তকে মঙ্গলবার পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মনোজিত মিশ্র নামের একজন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (TMCP) নেতা বলে জানা গেছে। অভিযোগ, ২৫শে জুন কলেজে এই গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত তিনজনকে আলিপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার লার্নড অ্যাডিশনাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (ACJM)-এর সামনে হাজির করা হয়, যেখানে পুলিশ বিস্তারিত তদন্তের জন্য তাদের হেফাজত চেয়েছিল। মনোজিত মিশ্রের ফেসবুক প্রোফাইলে ‘সাংগঠনিক সম্পাদক, দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদ’ এবং কলেজের টিএমসিপি ইউনিটের প্রাক্তন ‘প্রেসিডেন্ট’ পদের উল্লেখ রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ফলোয়ারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এমন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গণধর্ষণের মতো অভিযোগ উঠতেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। যদিও মনোজিতের দলে কোনো পদ আছে কিনা, সে বিষয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কোনো মন্তব্য করেনি। জানা যাচ্ছে, প্রাক্তনী হলেও কলেজে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মনোজিতের। কলেজের পরিচালন কমিটির সুপারিশে তাকে প্রতিষ্ঠানের অস্থায়ী স্টাফ হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল।
মেডিকেল ও ফরেন্সিক তদন্ত
অভিযোগ দায়েরের পর পরই নির্যাতিতাকে চিকিৎসার জন্য চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে (পূর্বের নাম পার্ক সার্কাসের কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে) নিয়ে যাওয়া হয়। মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে বলে পুলিশ মনে করছে। একটি ফরেন্সিক দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সংগ্রহ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা তদন্তে সহায়তা করবে। অপরাধের সময় অভিযুক্তরা কোনো প্রমাণ ছেড়ে গিয়েছে কিনা, তা দেখা হবে। ঘটনাস্থল কর্ডন করে দেওয়া হয়েছে।
উত্থাপিত প্রশ্ন এবং চলমান তদন্তের দিক
এত বড় ঘটনা কীভাবে কলেজ চত্বরে ঘটল—সেই প্রশ্নে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ঘটনার সময় কলেজের ভিতরে আর কে কে ছিল, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার আগে-পরে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তরুণীর সঙ্গে তিন অভিযুক্তের কতটা পরিচয় ছিল, তাঁকে কীভাবে ডেকে পাঠানো হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযুক্তদের স্মার্টফোন বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। ঘটনার সময় অন্য ছাত্রছাত্রীরা কী করছিলেন, কেন কেউ কিছু টের পেল না, সেই প্রশ্নও উঠছে। পুলিশ সূত্রে আরও জানানো হয়েছে, অভিযুক্ত তিনজনের মোবাইল কল রেকর্ড ও লোকেশন ডেটা খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে কলেজ কর্তৃপক্ষকেও ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ঘটনার সময় কলেজ পঠনপাঠন চলছিল না। তবে একটি অনুষ্ঠান চলছিল বলে দাবি। প্রশ্ন উঠছে, কলেজে তখন নিরাপত্তারক্ষীরা কোথায় ছিলেন?
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও নারী নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
এই ঘটনা নিয়ে বিরোধী দলনেতা ও বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করেছেন। তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে থাকার যোগ্যতা তাঁর নেই। শুভেন্দু অধিকারী আরও বলেন, “আমরা ইস্যু চেকআপ করছি। এই ইস্যু অনেক বড় হবে। গোটা কলকাতা পুলিশকে দিঘায় নিয়ে চলে গিয়েছে। এবার উনি বলবেন ছোট ঘটনা, লাভ অ্যাফেয়ার ছিল। বলবেন অভিযোগকারী গর্ভবর্তী, তারপর বলবেন ১০ লক্ষ তো দেওয়া যেতেই পারে।” বিরোধী দল বিজেপি এই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামবে বলেও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
পাল্টা তৃণমূল নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্যকে “ধর্ষণকারীদেরই উৎসাহিত করছে” বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এসব ঘটনা রুখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিকরণ করলে হবে না। বিজেপি শাসিত রাজ্যেও হয়। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেও নারী নির্যাতনের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ।” যদিও এক্ষেত্রে কচুবনে সেই প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং কোনও বিজেপির কর্মী সরাসরি অভিযুক্ত হয়নি ।
রাজ্য পরিচালিত আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গত বছরের ৮ ও ৯ আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে এক পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট প্রশিক্ষণার্থীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এই ঘৃণ্য ঘটনা ঘটল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই ধরনের জঘন্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি শহর জুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে দিয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং একটি শক্তিশালী ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে। স্থানীয়রা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।