ব্যুরো নিউজ ১৯ জুন : পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান প্রায়শই স্ববিরোধী বলে সমালোচিত হয়। সম্প্রতি শুভেন্দু অধিকারীর একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে UAPA ধারায় মামলা করার দাবি উঠেছে, যেখানে দলীয় সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন। এই ঘটনাপ্রবাহ তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থান এবং সংবিধানের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য ও তৃণমূলের আক্রমণ
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সম্প্রতি বাংলাদেশের ইউনুস সরকারের কার্যকারিতা পশ্চিমবঙ্গের সরকারের চেয়ে ভালো বলে মন্তব্য করেছেন। এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেস শুভেন্দু অধিকারীকে ‘ভারত-বিরোধী’ আখ্যা দিয়েছে এবং তাঁর গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে। তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তী বলেছেন যে, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে এমন মন্তব্য ‘জাতি-বিরোধী’ এবং এটি ভারতের বদনাম করার শামিল। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “কীভাবে একজন নেতা ভারতের একটি রাজ্য সরকারের কার্যকারিতাকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন? এটা কি ভারতের সম্মানহানি নয়?” একইসাথে তিনি বিজেপির নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ নিয়ে আপত্তি
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের মোদী সরকার কর্তৃক ২৫শে জুনকে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেছেন। কংগ্রেস সরকার কর্তৃক ৫০ বছর আগে জারি করা জরুরি অবস্থাকে স্মরণ করে কেন্দ্র এই দিবস পালনের নির্দেশ দিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই উদ্যোগকে ‘গণতন্ত্র ধ্বংসের’ প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রতিদিন সংবিধান বদলানো হচ্ছে, পরিকল্পিত ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। তাঁর মতে, “দেশে তো প্রতি দিন গণতন্ত্র হত্যা করা হচ্ছে। প্রতি দিনই এই দিবস পালিত হওয়া উচিত। সংবিধান রোজ বদলানো হচ্ছে।” তিনি আরও জানিয়েছেন যে, ২৫শে জুন রাজ্যে এমন কোনো দিবস পালন করা হবে না।
তৃণমূলের স্ববিরোধী অবস্থান: এক বিশ্লেষণ
এখানেই তৃণমূলের স্ববিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে, শুভেন্দু অধিকারীর একটি তুলনামূলক মন্তব্যকে ‘ভারত-বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে UAPA-এর মতো কঠোর আইন প্রয়োগের দাবি জানানো হচ্ছে, যা সাধারণত সন্ত্রাসবাদ বা দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত কার্যকলাপের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং জরুরি অবস্থার সময় সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দগুলি সংযোজনকে (যা বিরোধীদের অযৌক্তিকভাবে কারারুদ্ধ করার প্রেক্ষাপটে ঘটেছিল) সংবিধানের লঙ্ঘন হিসাবে সরাসরি উল্লেখ করছেন না, বরং পূর্বে ঘটে যাওয়া দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থার নিন্দার সঙ্কল্প প্রত্যাখান করছেন।
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন যে, “দেশ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট। বাংলা ভাগ হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২০ জুন। সেই সময় দেশ স্বাধীন হয়নি।” এই মন্তব্য ভারতের সাংবিধানিক অখণ্ডতা এবং স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রতি তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের স্পষ্ট অজ্ঞতাকে প্রকাশ করে। পশ্চিমবঙ্গের সৃষ্টি যে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অধীনে একটি রাজ্য হিসেবে হয়েছিল, তার সাথে ভারতের স্বাধীনতার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এটি বিভাজনের একটি অংশ ছিল।
দুর্নীতি ও ভণ্ডামি: তৃণমূল শাসনের বৈশিষ্ট্য?
তৃণমূল শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য দুর্নীতি ও ভণ্ডামিকেই তুলে ধরেছে। যখন শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশের একটি অস্থিতিশীল ইউনুস সরকারের সঙ্গে তুলনা করে পশ্চিমবঙ্গের অরাজক পরিস্থিতিকে তুলে ধরছেন, তখন তৃণমূল এটিকে অসাংবিধানিক এবং রাষ্ট্রবিরোধী বলে অভিহিত করছে। এই প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিত করে যে, তৃণমূল তাদের শাসনামলের সমালোচনাকে সহ্য করতে রাজি নয় এবং যেকোনো সমালোচনাই তাদের কাছে ‘দেশদ্রোহী’ বলে বিবেচিত হয়, এমনকি যখন তাদের নিজেদের শীর্ষ নেতারাই সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আনছেন।
উপসংহার : সর্বোপরি, এই ঘটনাপ্রবাহ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেসের স্ববিরোধী অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলে। একদিকে, তারা নিজেদেরকে সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, কিন্তু অন্যদিকে, বিরোধী দলের নেতার বিরুদ্ধে UAPA-এর মতো আইন প্রয়োগের দাবি তুলে এবং ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদেরই সাংবিধানিক জ্ঞান ও দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এটি বাংলার রাজনীতিতে এক ধরনের দ্বিচারিতা এবং ভণ্ডামির ইঙ্গিত দেয়, যা সুস্থ গণতান্ত্রিক বিতর্কের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।