ব্যুরো নিউজ ১৮ জুন : পশ্চিমবঙ্গে নতুন অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC) তালিকা নিয়ে বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রকাশিত OBC সংক্রান্ত সমস্ত বিজ্ঞপ্তির উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করেছে, যা রাজ্য সরকারের অস্বচ্ছতা এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণে ব্যর্থতাকে সামনে এনেছে। এর ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে ভর্তির প্রক্রিয়া সহ বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রমে আবারও জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রচার অভিযান ও বিজেপির অভিযোগ
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের নতুন OBC তালিকা নিয়ে বিজেপির ছড়ানো অপপ্রচারের বিরুদ্ধে একটি প্রচারাভিযান শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার রাজ্য মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তার মন্ত্রীদের সাধারণ মানুষের কাছে নতুন OBC তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য একটি বৃহৎ জনসংযোগ কর্মসূচী শুরু করার নির্দেশ দেন।
গত সপ্তাহে বিধানসভার চলমান বর্ষা অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন যে, OBC ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য নতুন সমীক্ষার সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরও দাবি করেন যে, OBC-A ক্যাটাগরিতে ৪৯টি এবং OBC-B ক্যাটাগরিতে ৯১টি জাতি রয়েছে এবং শীঘ্রই আরও ৫০টি জাতি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, এই সমীক্ষা অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে করা হয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে নয়।
তবে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক অমিত মালব্য মুখ্যমন্ত্রীর দাবিগুলির প্রতিক্রিয়ায় রাজ্য সরকারের তথ্য উদ্ধৃত করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, নতুন সমীক্ষায় OBC তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে “অযাচিত” অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
দার্জিলিং সাংসদের দাবি: ২০২৭ সালের আদমশুমারি একটি উন্নত ভারত গঠনে সহায়ক হবে
হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ ও আইনি জটিলতা
২০২৪ সালের মে মাসে কলকাতা হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০১০ সালের পর পশ্চিমবঙ্গে জারি করা সমস্ত OBC সার্টিফিকেট বাতিল করে দেয়। এর অর্থ ছিল যে, ২০১১ সাল থেকে রাজ্যে বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে জারি করা সমস্ত সার্টিফিকেট বাতিল হয়ে যাবে। এই আদেশের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টে যায় এবং চলতি বছরের মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে রাজ্যে OBCs চিহ্নিত করার জন্য একটি নতুন সমীক্ষা চালানোর অনুমতি দেয়। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার ডিভিশন বেঞ্চ গত মঙ্গলবার (১৭ জুন, ২০২৫) রাজ্য সরকার কর্তৃক OBC সংক্রান্ত যত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলোর উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করে। এই নির্দেশ আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এই মামলায় আবেদনকারীদের দাবি ছিল, রাজ্য সরকার আদালতের নির্দেশ মেনে সমীক্ষা করেনি এবং তা কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
আদালতের তরফে জানানো হয়েছে, কলকাতা হাইকোর্ট এই মামলায় আগে যে মূল নির্দেশ দিয়েছিল, সেখানে সরকারকে কীভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ করতে হবে তার উল্লেখ ছিল। কিন্তু সরকার সেই নির্দেশ মান্য করেনি। ২০১২ সাল পর্যন্ত যে OBC আইন ছিল তা সরকার একটা সময় পর্যন্ত মেনেছে, কিন্তু পুরোপুরি না মেনে ১৯৯৩ সালের আইন অনুযায়ী কাজ করেছে, যা ঠিক নয়। ২০১২ সালের আইনে যে সংশোধনী আনার দরকার ছিল তা করা হয়নি। সেই কারণে সরকার OBC সংক্রান্ত যে যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তাতে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ভর্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব ও ভবিষ্যৎ বিতর্ক
এই মামলার কারণে কলেজগুলিতে ভর্তির প্রক্রিয়া আটকে ছিল। রাজ্য শিক্ষা দফতর সম্প্রতি একটি কেন্দ্রীভূত পোর্টাল চালু করেছে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য, যদিও আবেদনকারীদের OBC স্ট্যাটাস নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনও বিদ্যমান। এটি ভবিষ্যতে আরও একটি বিতর্কের জন্ম দিতে পারে, যা তৃণমূল-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের অদক্ষতার একটি বৈশিষ্ট্য বলে ধারণা।
রাজনৈতিক মঞ্চে শুভেন্দু অধিকারী: লাড্ডু বিতরণ ও কীর্তন যাত্রা!
এদিকে, মাননীয় কলকাতা হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণকে সাদরে গ্রহণ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। বুধবার তিনি বিধানসভা চত্বরে লাড্ডু বিতরণ করে এবং কীর্তন মিছিল বের করে রাজ্য সরকারের OBC আদমশুমারির বাস্তবায়নে স্থগিতাদেশের উদযাপন করেছেন। খোল কর্তালের ছন্দে এক নিখুঁত চিত্রনাট্য! তিনি বুঝিয়ে দিলেন, কীভাবে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সাংবিধানিকভাবে রাজ্য সরকারের দুর্নীতিকে “নিঃসন্দেহে” ফাঁস করতে পারে। বোঝা গেল, সরকার যতই নতুন চাল চেলে যাক, বিরোধী দলের দুর্নীতি উন্মোচনে লাড্ডু আর কীর্তন সবসময়ই প্রস্তুত !
এনডিএ সরকারের প্রস্তাবিত জাতিগত জনগণনা: ২০২৭-এর মার্চ থেকে শুরু
সংখ্যালঘু কমিশন ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ
রাজ্য মন্ত্রিসভা সোমবার একটি বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের জন্য দুটি সহ-সভাপতি পদ তৈরির প্রস্তাবও পাশ করেছে। গত সপ্তাহে, পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশন (সংশোধন) বিল, ২০২৫, বিধানসভায় পাশ হয়, যার ফলে কমিশনের জন্য পূর্বের অনুমোদিত একটি পদের পরিবর্তে দুটি সহ-সভাপতি নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। এই পদক্ষেপকে অনেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সংখ্যালঘু ভোটব্যাংককে ধরে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন, বিশেষ করে যখন OBC সংরক্ষণ নিয়ে এত বিতর্ক চলছে।
সামগ্রিকভাবে, পশ্চিমবঙ্গের OBC সংরক্ষণ বিতর্ক একটি জটিল আইনি এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। রাজ্য সরকারের স্বচ্ছতার অভাব এবং আদালতের নির্দেশ পালনে ব্যর্থতা ভবিষ্যতে আরও আইনি জটিলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে।