ব্যুরো নিউজ  ৪ জুন : আসন্ন ঈদ-উল-আযহা বা বকরিদের সময় কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে কোরবানি নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিয়ে তীব্র বিতর্কে জড়িয়ে পড়া কূটনীতিক শাবাব বিন আহমেদকে অবশেষে পদচ্যুত করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন)। ঢাকাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্তের জেরে বৃহস্পতিবার (২৩ মে, ২০২৫) বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে অবিলম্বে ঢাকায় ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েছে। এই ঘটনা ঐতিহ্য, কূটনৈতিক রীতিনীতি এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন সমীকরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।


কোরবানি নিষিদ্ধের বিতর্কিত নির্দেশ ও ঐতিহ্য ভঙ্গ

ঈদ-উল-আযহার আগে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে গরু ও ছাগল কোরবানি বন্ধের নির্দেশ জারি করেন কূটনীতিক শাবাব বিন আহমেদ। যদিও তিনি তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি; জুনের প্রথম সপ্তাহে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল। এই নির্দেশ কূটনৈতিক নিয়মনীতি অমান্য করে দেওয়া হয়েছে বলে মিশনের অন্যান্য কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৩০ বছরের পুরনো এই ঐতিহ্য ভাঙার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রতি বছরই এই মিশনে গরু ও ছাগল কোরবানি দিয়ে স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে মাংস বিতরণ করা হতো, যার একটি বড় অংশ এতিমখানায় পাঠানো হতো। মিশনের আশেপাশে বসবাসকারী ৯০ শতাংশ মুসলিমও এই মাংস পেয়ে থাকেন।

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে

শাবাব বিন আহমেদ তার এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, “আমরা বিদেশে দেশের প্রতিনিধিত্ব করি। তাই স্থানীয় রীতি ও পরিবেশের প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে। অন্য কোনো বিদেশি বাংলাদেশি মিশনে কোরবানি হয় না।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের আবেগের কথা মাথায় রেখেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তার এই বক্তব্যে মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কেউই সন্তুষ্ট হননি। এটিকে ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’ হিসেবেও অনেকে দেখছেন।


কূটনীতিকের অপসারণ ও ইউনূস সরকারের পদক্ষেপ

এই বিতর্কিত নির্দেশের জেরে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। শাবাব বিন আহমেদ, যিনি পূর্বে নেদারল্যান্ডসের হেগে কর্মরত ছিলেন এবং ২১ নভেম্বর ২০২৪ থেকে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন, তার কলকাতাস্থ নিয়োগ বাতিল করে তাকে সরাসরি ঢাকায় ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ এবং ‘সংবাদ প্রতিদিন’ এই খবর নিশ্চিত করেছে।

এই ঘটনা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিও আঙুল তুলেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইসলামপন্থীদের চাপে আছে বলে অনেক মহলে অভিযোগ উঠেছে। এই সরকারের পররাষ্ট্রনীতি এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে কিছু অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এর আগে জামাত-ই-ইসলামি এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবিরের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার মতো পদক্ষেপও ইউনূস সরকার নিয়েছিল, যা তাদের উপর ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।


ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও কূটনৈতিক সংবেদনশীলতা

কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনে কোরবানির ঐতিহ্য বন্ধ করার এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও টানাপোড়েনের মুখে ফেলতে পারত। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ‘খুবই দৃঢ়’ এবং ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে অভিহিত করলেও, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারত সম্পর্কে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করেছে বলে কিছু বিশ্লেষক মনে করেন। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় চীন ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের সুষম সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি হলেও, এই ধরনের ঘটনা ভুল বার্তা দিতে পারে।

আলিপুরদুয়ারের জনসভায় মোদীর বার্তা : ‘নির্মম সরকার’কে উপড়ে ফেলে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’র ডাক!

কূটনৈতিক মিশনগুলো সাধারণত স্বাগতিক দেশের রীতিনীতি ও সংবেদনশীলতাকে সম্মান করে থাকে। তবে, ধর্মীয় ঐতিহ্য পালনের ক্ষেত্রে নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিশ্বাস বজায় রাখারও একটি ভারসাম্যপূর্ণ দিক থাকে। কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রায় ৩০ বছরের কোরবানি পালনের ঐতিহ্য এবং স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর এতে অংশগ্রহণের বিষয়টি একটি সংবেদনশীল প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এই ঘটনাকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিজেপি-আরএসএস, তাদের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে, যা আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠতে পারত।

সামগ্রিকভাবে, এই ঘটনা শুধু একজন কূটনীতিকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা পদচ্যুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ চাপ এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সংবেদনশীলতার উপর আলোকপাত করেছে।

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর