ব্যুরো নিউজ  ৪ জুন : বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্রতম ৭৫টি দেশ ২০২৫ সালে চীনকে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বৈদেশিক নীতি বিষয়ক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক লোয়ি ইনস্টিটিউটের (Lowy Institute) এক নতুন প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই বিশাল ঋণের বোঝা মূলত চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI) প্রকল্পের অধীনে দেওয়া ঋণের ফল।


ঋণের সুনামির মুখে দুর্বলতম জাতিগোষ্ঠী

লোয়ি ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত এবং দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সতর্ক করে বলেছে যে, “পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো ঋণের সুনামির মুখোমুখি, কারণ চীনের ঋণ বিতরণ ব্যবস্থা এখন পরিশোধের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।” দুর্বল দেশগুলোকে এই বছর রেকর্ড ২২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে, যার বেশিরভাগই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের স্বপ্নের BRI প্রকল্পের অধীনে ইস্যু করা ঋণের সঙ্গে সম্পর্কিত। লোয়ি ইনস্টিটিউট কর্তৃক ২০২৫ সালের জন্য মোট ৩৫ বিলিয়ন ডলারের যে হিসাব করা হয়েছে, তার মধ্যে এই ৭৫টি দেশের ঋণই সিংহভাগ।

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে


চীন এখন ‘ব্যাংকার’ নয়, ‘ঋণ আদায়কারী’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের জন্য ২৪০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে… এখন এবং এই দশকের বাকি সময় ধরে, উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে চীন ব্যাংকারের চেয়ে বেশি ঋণ আদায়কারী হিসেবে থাকবে।” এই ঋণ পরিশোধের চাপ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় স্থানীয় তহবিলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, “চীন যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল, তখনই তার ঋণ বিতরণ বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে দেশগুলো তীব্র অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও বড় আকারের আর্থিক বহিঃপ্রবাহ তৈরি হচ্ছে।”


‘ঋণের ফাঁদ’ বিতর্ক ও রাজনৈতিক প্রভাব

চীনের এই ঋণ বিতরণ পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মহলে বারবার ‘ঋণের ফাঁদ’ (Debt Trap) হিসেবে সমালোচিত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে বেইজিং এই দেশগুলোকে অপরিশোধযোগ্য ঋণের জালে জড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। যদিও চীন সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণের ফাঁদ তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলোও পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেছে যে, যখন অন্যান্য দেশ ঋণ দিতে অস্বীকার করেছে, তখন চীন একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ঋণ দিয়েছে।তবে, লোয়ি ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, চীনের কাছে বকেয়া এই রেকর্ড পরিমাণ ঋণ “রাজনৈতিক সুবিধা” হাসিলের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বৈদেশিক সহায়তায় ব্যাপক কমানোর মধ্যে এই ঋণের বোঝা আসছে।

প্রতিবেদনটি হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, বুর্কিনা ফাসো এবং ডোমিনিকান রিপাবলিকের মতো দেশগুলোকে দেওয়া নতুন বড় আকারের ঋণের কথাও তুলে ধরেছে, যা এই দেশগুলোর তাইওয়ান থেকে বেইজিংয়ে কূটনৈতিক স্বীকৃতি পরিবর্তনের ১৮ মাসের মধ্যেই দেওয়া হয়েছে। চীন এখনও পাকিস্তান, কাজাখস্তান, লাওস এবং মঙ্গোলিয়ার মতো কিছু কৌশলগত অংশীদারদের পাশাপাশি আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও ধাতু উৎপাদনকারী দেশগুলোতে অর্থায়ন চালিয়ে যাচ্ছে।


সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও বাস্তব দ্বিচারিতা

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (Chinese Communist Party), যা নীতিগতভাবে একটি সমাজতান্ত্রিক দল, তারা দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করার পরিবর্তে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে বাস্তবে তাদের ঘোষিত আদর্শ থেকে ব্যাপক বিচ্যুতি প্রদর্শন করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সফল কমিউনিস্ট শাসন হিসেবে পরিচিত চীনের এই পদক্ষেপ সমাজতান্ত্রিক মতবাদের অন্তর্নিহিত ভণ্ডামিকেই উন্মোচিত করে। ইতিহাস সাক্ষী, বেশিরভাগ কমিউনিস্ট রাষ্ট্রই শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মকবাদী এবং সম্প্রসারণবাদী নীতি গ্রহণ করেছে, যা দুর্বল জাতিগুলোর প্রতি তাদের আচরণের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। এই ঋণের বোঝা দরিদ্র দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে, যা সমাজতান্ত্রিক সাম্য ও সহায়তার মূল ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।

‘দক্ষিণায় পাক অধিকৃত কাশ্মির চাই’: সেনাপ্রধানকে জগদ্গুরু রামভদ্রাচার্য্যের স্পষ্ট বার্তা


চীনের নিজস্ব অর্থনৈতিক সংকট ও তথ্যের অপ্রতুলতা

এই পরিস্থিতি চীনকেও একটি উভয় সংকটে ফেলেছে। একদিকে দুর্বল দেশগুলোর ঋণের পুনর্গঠন নিয়ে কূটনৈতিক চাপ, অন্যদিকে চীনের নিজস্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অভ্যন্তরীণভাবে ঋণ আদায়ের চাপ।

চীন তার BRI প্রকল্প সম্পর্কে খুব কম তথ্য প্রকাশ করে। লোয়ি ইনস্টিটিউট জানিয়েছে যে তাদের অনুমান (যা বিশ্বব্যাংকের তথ্যের উপর ভিত্তি করে) চীনের ঋণের সম্পূর্ণ পরিমাণকে সম্ভবত কম করে দেখিয়েছে। ২০২১ সালে এইড ডেটা (Aid Data) অনুমান করেছিল যে চীনের ‘গোপন ঋণ’ (Hidden Debt) প্রায় ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার। এই অপ্রতুল তথ্য ঋণের প্রকৃত মাত্রা এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলছে।

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর