lord ganeshji

ব্যুরো নিউজ ০৫ নভেম্বর ২০২৫ : সৃষ্টির আদিকাল হইতে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে গণেশ দেবতা এক বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার নাম উচ্চারিত হইলেই এক অনাবিল শান্তি এবং ইতিবাচকতার অনুভূতি আসে। বিঘ্ননাশক, প্রজ্ঞার অধিপতি এবং সাফল্যের অগ্রদূত রূপে পরিচিত এই দেবতাকে প্রতিটি শুভ কাজের প্রারম্ভে পূজা করা হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, গণেশ দেবের বহু পবিত্র নাম রহিয়াছে, যাহার প্রত্যেকটির গভীর ও শক্তিশালী অর্থ বিদ্যমান। এই নামগুলি কেবল উপাধি নহে, বরং তাঁহার দিব্য ভূমিকা, গুণাবলী এবং ভক্তদের প্রতি তাঁহার অনন্ত আশীর্বাদের প্রতিচ্ছবি। এই প্রবন্ধে আমরা গণেশ দেবের ১০টি পবিত্র নাম এবং সেই নামগুলির অন্তরালে লুকানো সুন্দর অর্থগুলি অনুধাবন করিব।


গণেশ নামের অলৌকিক গুরুত্ব

সনাতন ধর্মে দেব-দেবীর প্রতিটি নামেরই এক গভীর তাৎপর্য রহিয়াছে। গণেশ চতুর্থী বা অন্যান্য পূজা-পার্বণে তাঁহার নাম জপ করা হয়। এই নামগুলি শক্তিশালী মন্ত্রস্বরূপ, যাহা তাঁহার আশীর্বাদকে আহ্বান করে এবং জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সুরক্ষা লইয়া আসে। প্রতিটি নাম গণেশ দেবের বিশেষ গুণ বা শক্তিকে আলোকিত করে। ভক্তিভরে এই নামগুলি জপ করিলে ভক্তরা গণেশের দিব্য শক্তির সহিত যুক্ত হইতে পারেন এবং জীবনে তাঁহার পথনির্দেশ লাভ করেন বলিয়া বিশ্বাস করেন।

‘গণেশ অষ্টোত্তর শতনামাবলী’তে গণেশের ১০৮টি নাম রহিয়াছে, যাহা তাঁহার বিভিন্ন গুণকে প্রকাশ করে। তবে আমরা এখানে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ও অর্থপূর্ণ ১০টি পবিত্র নামের উপর দৃষ্টিপাত করিব, যাহা যুগ যুগ ধরিয়া ভক্তদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস অনুপ্রাণিত করিয়াছে।

Ganeshji : সিদ্ধিদাতা গণেশের চার হাতের রহস্য !


গণেশ দেবের দশটি পবিত্র নাম ও তাহার তাৎপর্য

১. বিঘ্নহর্তা (Vighnaharta) – বাধা দূরকারী

গণেশ দেবের অন্যতম প্রসিদ্ধ নাম হইল ‘বিঘ্নহর্তা’। অর্থাৎ, যিনি তাঁহার ভক্তদের পথ হইতে সমস্ত বাধা দূর করেন। যেকোনো নতুন উদ্যোগ, যাত্রা অথবা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের পূর্বে মানুষজন তাঁহার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন, যাহাতে কাজ সুসম্পন্ন হয় ও সফলতা আসে। এই নাম জপ করিলে গণেশ সমস্ত পথ পরিষ্কার করিয়া দেন এবং ভক্তদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস প্রদান করেন।

 

২. গণপতি (Ganapati) – বহুজনের অধিপতি

‘গণপতি’ নামটি ‘গণ’ (অর্থাৎ, বহু বা দল) এবং ‘পতি’ (অর্থাৎ, প্রভু বা কর্তা) এই দুইটি শব্দ হইতে আসিয়াছে। গণপতি রূপে গণেশ দেব দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সকল সত্ত্বার নেতা। তিনি এই মহাবিশ্বের সকল শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখেন, যাহা ভক্তদের যেকোনো পরিস্থিতিতে পথ দেখাইতে সক্ষম। এই নাম নেতৃত্ব, ঐক্য ও সুরক্ষার প্রতীক।

 

৩. লম্বোদর (Lambodara) – বৃহৎ উদরধারী

‘লম্বোদর’ গণেশের বিশাল উদরকে নির্দেশ করে, যাহা অনন্ত মহাবিশ্বকে ধারণ করে। ইহা জীবনের সকল অভিজ্ঞতা, ভালো-মন্দ, শান্তভাবে ও সহানুভূতির সহিত হজম করিবার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। তাঁহার বৃহৎ উদর প্রাচুর্য, উদারতা এবং সন্তুষ্টিরও প্রতীক।

 

৪. একদন্ত (Ekadanta) – এক দাঁতযুক্ত

‘একদন্ত’ নামের অর্থ হইল— যাহার একটি মাত্র দাঁত। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, মহাভারত রচনার সময় লেখনী ভাঙিয়া গেলে গণেশ নিজ দত্ত (দাঁত) ভাঙিয়া লেখা অব্যাহত রাখিয়াছিলেন। এই কর্মটি আত্মত্যাগ, সংকল্প ও নিঃস্বার্থতার প্রতীক। এই নাম ভক্তদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার গুরুত্ব শিক্ষা দেয়।

 

৫. গজানন (Gajanan) – হস্তীর মুখযুক্ত

‘গজানন’ অর্থ— যাহার মুখ হস্তীর ন্যায়। হস্তীর মাথা প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং শক্তির প্রতীক। হস্তী তাহার বুদ্ধি ও স্মৃতির জন্য পরিচিত, তেমনই গণেশ দেব তাঁহার ভক্তদের জ্ঞান ও উপলব্ধির দিকে চালিত করেন। গজাননের বিশাল কর্ণদ্বয় ধৈর্য সহকারে শুনিবার ক্ষমতাকে বোঝায়, যাহা আমাদের জীবনে সু-শ্রোতা ও শিক্ষার্থী হইবার মূল্য শিক্ষা দেয়।

 

৬. বক্রতুণ্ড (Vakratunda) – বক্র শুণ্ডধারী

‘বক্রতুণ্ড’ অর্থ— যাহার শুণ্ডটি বাঁকানো। বাঁকানো শুণ্ড নমনীয়তা ও অভিযোজন ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। গণেশ দেব তাঁহার এই রূপের দ্বারা শিক্ষা দেন যে, জীবনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও লক্ষ্য স্থির রাখিয়া নমনীয় হইতে হইবে। এই নাম মানসিক শক্তি ও সহনশীলতার প্রেরণা জোগায়।

 

৭. সিদ্ধিবিনায়ক (Siddhivinayak) – সফলতা প্রদানকারী

‘সিদ্ধিবিনায়ক’ অর্থ— যিনি সাফল্য ও সিদ্ধি প্রদান করেন। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, ভক্তিভরে গণেশের পূজা করিলে তাঁহাদের সকল প্রচেষ্টায় সুফল লাভ হইবে। এই নাম আশা ও ইতিবাচকতা বহন করে। ছাত্র-ছাত্রী, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীরা এই নামে বিশেষভাবে গণেশ দেবের পূজা করেন।

 

৮. ধূম্রকেতু (Dhoomraketu) – ধূম্ররূপী প্রভু

‘ধূম্রকেতু’ গণেশের একটি কম পরিচিত কিন্তু শক্তিশালী নাম। অর্থ— যিনি ধূম্রকেতুর ন্যায় আবির্ভূত হন। এই রূপটি গণেশের সেই ক্ষমতাকে বর্ণনা করে, যাহার দ্বারা তিনি নেতিবাচকতা ও অশুভ শক্তিকে পরিবেশ হইতে অপসারণ করেন। এই নাম জপ করিলে পরিবেশ শুদ্ধ হয় এবং ইতিবাচক শক্তি আসিয়া থাকে।

 

৯. বালচন্দ্র (Balachandra) – মাথায় অর্ধচন্দ্রধারী

‘বালচন্দ্র’ অর্থ— যিনি তাঁহার মস্তকে অর্ধচন্দ্র ধারণ করেন। এই নাম সৌন্দর্য, শান্ততা এবং সময়ের গতিকে নির্দেশ করে। চন্দ্র মন ও আবেগের সহিত যুক্ত। মস্তকে চন্দ্র ধারণ করিয়া গণেশ তাঁহার আবেগ ও মানসিক স্থিতির উপর কর্তৃত্ব দেখান। ভক্তরা এই নাম জপ করিয়া মানসিক ভারসাম্য ও স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা লাভ করেন।

 

১০. হেরম্ব (Heramba) – দুর্বলদের রক্ষাকর্তা

‘হেরম্ব’ অর্থ— অসহায় ও দুর্বলদের রক্ষাকর্তা। হেরম্ব রূপে গণেশ একজন করুণাময় অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন, যিনি তাঁহার ভক্তদের ক্ষতি ও অবিচার হইতে রক্ষা করেন। এই নাম গণেশের দয়ালু ও প্রেমময় সত্ত্বাকে প্রকাশ করে। ভক্তরা এই নামে নিজেদের সংগ্রামে একা নন, গণেশ সর্বদা তাঁহাদের পাশে আছেন, এই আশ্বাস পান।

Ganeshji : গণেশ অষ্টাবতার: মানুষ ও দেবতার আটটি রিপু বিনাশের পৌরাণিক আখ্যান

নাম জপের শক্তি ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা

গণেশ দেবের নাম জপ কেবল একটি ধর্মীয় প্রথা নহে, ইহা এক প্রকারের ধ্যান, যাহা মনকে শান্তি, মনোযোগ এবং ইতিবাচকতা প্রদান করে। প্রতিটি নামের নির্দিষ্ট স্পন্দন ও শক্তি মন এবং শরীরকে প্রভাবিত করে। ভক্তরা যখন ভক্তি ও আন্তরিকতার সহিত এই পবিত্র নামগুলি জপ করেন, তখন তাঁহারা গণেশের দিব্য উপস্থিতির সহিত এক গভীর সংযোগ অনুভব করেন। এই অভ্যাস দুশ্চিন্তা কমায়, নেতিবাচক চিন্তা দূর করে এবং জীবনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করিবার সাহস জোগায়।

আমরা যেন গণেশের এই নামগুলিকে কেবল মন্ত্ররূপে নহে, বরং জীবনের চালিকাশক্তি রূপে গ্রহণ করি। তাঁহার নাম আমাদের লম্বোদরের ন্যায় ধৈর্যশীল, গজাননের ন্যায় প্রজ্ঞাবান, একদন্তের ন্যায় সংকল্পবদ্ধ এবং হেরম্বের ন্যায় দয়ালু হইতে অনুপ্রাণিত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর