কালী

ব্যুরো নিউজ, ১ নভেম্বর: ইতিহাসে ছেদ পড়েনি বর্ধমানের কালীপুজোয়

বর্ধমানে পূজিত হয়ে আসছে শতাধিক বছরের পুরনো একাধিক কালী প্রতিমা। সেই কালীপুজোকে নিয়ে রয়েছে ইতিহাস। সেই ইতিহাস বর্ণনা করলেন, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সর্বজিত যশ।

সোনার কালী : ১৩০৬ বঙ্গাব্দে নারায়ণ কুমারী স্বপ্নাদেশ পেয়ে সোনার কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। সোনার কালীবাড়ির বিগ্রহ দশ মহাবিদ্যার ভুবনেশ্বরী কালী। অর্থাৎ এই কালীমূর্তি প্রসন্নমূর্তি। এখানে শিব নেই। দেবীর সিংহাসনটি রুপোর। বেদিটি শ্বেতপাথরের।

রানি নারায়ণ কুমারী একজন ব্রাহ্মণ কুমারীকে বেদীর নীচে প্রতিষ্ঠা করে অষ্টধাতুর এই ভুবনেশ্বরী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ভুবনেশ্বরী কালীর ডানদিকে দক্ষিণাকালী, বাঁদিকে মঙ্গলচণ্ডী। ঈশান কোণে পঞ্চমুণ্ডির আসন।

লোকমুখে প্রচারিত, মা ভুবনেশ্বরীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার সময় এখানে একটি শিশুকন্যাকে জীবন্ত অবস্থায় পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। মূল মন্দিরের দক্ষিণ দিকে দুটি নারায়ণীশ্বর শিবমন্দির ও বেলগাছ আছে।

কঙ্কালেশ্বরী কালী : কাঞ্চননগরের কঙ্কালেশ্বরী মূর্তি প্রত্নতত্ত্ববিদ ও মূর্তিতত্ত্ববিদদের কাছে এক বিস্ময়। এ পর্যন্ত মূর্তিটি নিয়ে অনেক জল্পনা হয়েছে। কেউ বলেন বৌদ্ধ দেবী, কেউ বলেন জৈন, আবার কেউ মনে করেন বাংলার নিজস্ব সম্পদ– শাক্ত সম্প্রদায়ের উপাসিতা দেবীর উগ্রমূর্তি।

উত্‍সবের মরসুমে মিষ্টিমুখ থেকে বঞ্ছিত! বাড়িতে বানিয়ে ফেলুন চট-জলদি সুগার ফ্রি মিষ্টি

মূর্তির বর্ণনা করে বলা যায়, কালো পাথরের মূর্তি, একদা এর উপর কালো রং মাখানো হয়েছিল, পায়ের দিকে সেই কালো রং উঠে গেছে ও ভিতরের কালো পাথর বেরিয়ে এসেছে। মূর্তিটি প্রায় সাড়ে তিন হাত লম্বা, চওড়ায় প্রায় দেড় হাত। মূর্তিটি মন্দিরের দেওয়ালে সাঁটা আছে। দেবী কঙ্কালেশ্বরীর আকৃতি কঙ্কালের আকারের।

দুর্লভা কালী : নবাব হাটের খুব কাছে অবস্থিত দুর্লভা কালী মন্দির। প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এই দেবী। অনেকে চলতি কথায় “দুল বালা” কালীও বলে থাকেন। মায়ের যে মূর্তিটি সামনে দেখা যায় তার পিছনে রয়েছে আসল মূর্তি। তবে আসল মূর্তিটি পাথরের। প্রত্যহ পূজার সময় মূর্তি নামিয়ে পূজা করা হয় আসল পাথরের মূর্তির।

এই মূর্তিটি একখণ্ড কালো পাথরের উপর মায়ের চোখ, মুখ ও কান অল্প খোদাই করা। তবে কাছ থেকে তা বোঝা যায়। বাকী অংশ অমসৃণ পাথরের খণ্ড। সর্বসাধারণকে যে মূর্তিটি দেখতে দেওয়া হয় তা ঢালাইয়ের মূর্তি, তাতে পিতল-রং করা।

একই স্থানে শিবমন্দির, নারায়ণ মন্দির, তুলসি মঞ্চ রয়েছে। দুর্লভা কালী খুব জাগ্রতা দেবী বলে বিশ্বাস। এখানে মায়ের পূজা ছাড়াও প্রতিদিন তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা হয়। প্রতিদিন ভোগ হয় যা ‘শিব ভোগ” নামে পরিচিত, এই ভোগ একটি বাঁধানো বেদীতে রাখা হয়, যা শিয়ালে খেয়ে যায়।

বৈশাখ মাসের সংক্রান্তির দিন খুব ধুমধাম সহকারে পূজা হয়। পূর্বে প্রতি অমাবস্যায় ও পূর্ণিমায় ছাগ বলি হত, এখন শুধুমাত্র দুর্গা পূজার অষ্টমী ও নবমীতে ছাগ বলি হয়।

ফৌজদারী কালী: শহরের প্রাণকেন্দ্র খোসবাগানে এখনও প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে ফৌজদারি কালীর পুজো হয়। তিনি বাগদি সম্প্রদায়ের কালী বলেই পরিচিত।

১৩৪৫ খ্রিঃপূর্বে ফৌজদারী কালীমা বাগদী পাড়ার কালী রূপে পূজিতা হতেন। সেই সময় খোসবাগানের যে কয়েক ঘর অদিবাসী ছিলেন তাঁরা সকলেই স্বেচ্ছায় এই পুজো শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় প্রতিমা নিরঞ্জনকে কেন্দ্র করে সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়।

১৩৪৫ সনের ৩০শে কার্তিক রাত্রি ৮ ঘটিকায় স্থানীয় যুবকেরা একটি ঢোল ও একটি কাসি নিয়ে তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় নামক একটি যুবকের মাথায় প্রতিমাকে চাপিয়ে শহর পরিক্রমায় বের হয়। তখন বর্ধমান থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ছিলেন মহম্মদ বাবর আলি। তিনি ওই শোভাযাত্রাকে বাধা না দিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে শোভাযাত্রা নিয়ে গিয়ে বিসর্জন করার পর ঐ সমস্ত যুবকদের গ্রেপ্তার করেন

তাদের এই কর্মের জন্য কালীর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা রুজু করেন। বর্ধমান আদালতে আইন অমান্য ও অন্যান্য মিথ্যা অপরাধে তাদের ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা হয়। তখনকার ব্যারিষ্টার হাইকোর্টে আপিল করে সকলকে মুক্ত করে আনেন এবং তখন থেকে শোভাযাত্রা করার আইন সম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই থেকেই এই দেবী ‘ফৌজদারি’ কালী নামে খ্যাত। বর্তমানে ফৌজদারী কালী মায়ের পুজো ও শোভাযাত্রা বেশ ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়।

বীরহাটার বড়মা কালী: লোকমুখে একথা শোনা যায় যে যখন জি.টি. রোডের পীচ রাস্তা হচ্ছিল। সেই সময়েও এই দেবী বিরাজমান ছিলেন। আরও শোনা যায় যে বাঁকা নদীর তীরবর্তী এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলে পূর্ণ, এই স্থানে একটি বেদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় যখন ঐ অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছিল। জনমজুরেরা মাটি কাটতে কাটতে ওই বেদী দেখতে পান। সম্বল শুধু এইটুকুই, এর থেকে বেশী এই মন্দিরের প্রাচীন ইতিহাস জানা যায় না।

বর্ধমানের প্রাচীন লোকজনের কাছ থেকে একথা শোনা যায় যে তখনকার দিনে রক্ষাকালী পুজো করা হত ম্যালেরিয়া, মহামারির আবির্ভাব ঘটলে এর থেকে মুক্তিলাভের জন্য। একথা অনুমান করা যায় যে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাঁশ খড় তালপাতার ছাউনি ঘেরা দিয়ে, শক্তপোক্ত ভাবে বেদীটিকে পুনর্ণিমান করা হয়। এই জায়গার ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়। এই সময় দেবীর পূজার কাজে নিযুক্ত ছিলেন দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের কোন এক ঘোষাল পরিবার।

বংশগোপাল নন্দ মহাশয়ের অর্থানুকুল্যে এবং স্বর্গীয় উপেন্দ্রনাথ রায় মহাশয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কালক্রমে এই বাঁশ খড় আর তালপাতার ছাউনি পাকা ঘরে পরিবর্তিত হয়। তখন থেকেই প্রতি অমাবস্যায় মা’র পূজা শুরু হয়। নাসিকের কাছে গোদাবরী তীরে ত্রম্বকেশ্বরে মন্দিরের চূড়ার আদলে এই মন্দিরের চূড়া এবং মন্দির অলঙ্কৃত করা হয়। বীরহাটার বড়মা কালীর প্রতিষ্ঠার সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও এ সম্পর্কে যে জনশ্রুতি আছে তা হল বিরাট এক কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজা। ডাকাতে কালী নামে এই কালী দেবীকে অনেকে অভিহিত করে থাকেন।

তবে এই কালী বর্ধমান শহরে বড়মা নামেই পরিচিত। এই মূর্তিটি বর্ধমান শহরের সর্ববৃহৎ কালী মূর্তি। হয়তো এই কারণেই এই নামে মা’কে ডাকা হয়। বর্তমান বীরহাটা কালীমাতা ট্রাষ্ট কমিটি পূজা ও মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনুমোদিত বিশ্বেশ্বরী চতুষ্পাঠীর অধ্যক্ষ শ্রী দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়, কাব্য ব্যাকরণ, কৃত্য স্মৃতিতীর্থ, বৌদ্ধ দর্শনাচার্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে ১৯৯২খ্রী থেকে এই কালী মূর্তির শুদ্ধাচারে পূজা করে আসছেন। উনিই এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। প্রতি অমাবস্যায় মায়ের বিশেষ পূজা, হোম ও ভোগ হয়। ইভিএম নিউজ

 

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর