ব্যুরো নিউজ, ২০ অক্টোবর: পুরুলিয়াতে জন্ম নতুন দেবতার
নবম বা দশম শতকের তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি ‘বিষ্ণু’ দেবতা রুপে পূজিত হচ্ছেন পুরুলিয়ার গ্রামে। সকাল সন্ধ্যা আরতির সঙ্গে নতুন দেবতা পাচ্ছেন দুপুরের ভোগও। চলছে এই দেবতার জন্য স্থায়ী মন্দির বানানোর প্রস্তুতিও। প্রসঙ্গত, গবেষণার জন্য যে মূর্তি সংগ্রহশালায় থাকা দরকার, সেই মূর্তির স্থান হয়েছে মন্দিরে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের পরিবর্তে প্রতিদিন মূর্তির গায়ে তেল ও সিঁদুর লেপছেন গ্রামবাসীরা। দিন দিন গ্রামে বাড়ছে ভক্তের ভিড়। কিন্তু এ মূর্তি যে অমূল্য তা জানার পরেও হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন। এখনও পর্যন্ত সে ভাবে উদ্ধারের কোন চেষ্টাই করা হয়নি। ভয়, মূর্তি উদ্ধার করতে গেলে আঘাত পাবে ‘ভাবাবেগ’। হতে পারে রাজনীতিও। ঘটনার সূত্রপাত হয় গত সোমবার থেকে। সকালে বরুয়াডি গ্রামের একটি জলাশয়ে মূর্তিটা দেখতে পায় গ্রামবাসীরা। খবর পেয়ে ভিড় জমাতে থাকেন গ্রামের অন্য বাসিন্দারাও। ক্রমে অন্য গ্রাম থেকেও আসতে থাকেন মানুষ। সেই ভিড়ের মধ্যেই কেউ বলে দেন গ্রামে ‘ভগবান’ এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গেই ভক্তির ধুম পড়ে যায়। মূর্তিটিকে ভাল করে স্নান করানো হয়। গায়ে লেপে দেওয়া হয় তেল ও সিঁদুর। তার পরে শুরু হয় মূর্তি স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থানের খোঁজ। পুরুলিয়া মফস্সল থানা এলাকার গোলামারায় আগে থেকেই কালভৈরবের মন্দির ছিল। সেখানেই জায়গা পান নতুন দেবতা। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে জেলার তথ্য সংস্কৃতি দফতর, সকলেই দুর্মুল্য মূর্তি উদ্ধারের খবর পেয়েছেন। গ্রামবাসীদের হাত থেকে উদ্ধারের চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা মূর্তি দিতে নারাজ। তাঁদের এক কথা, ভগবান নিজে এসেছেন গ্রামে, তাঁকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।
স্থানীয় বাসিন্দা তথা স্কুল শিক্ষক রবীন পাণ্ডে বলেন, ‘‘মূর্তিটি দেখে তা পালযুগ বা তারও আগের সময়কার মূর্তি বলে মনে হচ্ছে। এই জেলায় অতীতেও এমন মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সেগুলি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। এটি পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। এর মূল্য কোটি টাকা দিয়ে হিসাব করা যাবে না। গবেষণার জন্য এই মূর্তি অমূল্য সম্পদ"। তিনি জানান, একটা সময়ে পুরুলিয়া সমৃদ্ধ জৈন জনপদ ছিল। সেই সময়ের মূর্তিই হবে এটা। রবীন বলেন, "অনেক মূর্তিই গাছতলায় রেখে পুজো করা হয়। প্রশাসন উদ্ধার করতে পারেনি। এটির পরিণতিও কি তাই হতে চলেছে? যদি হয়, তবে মূর্তিটি সুরক্ষিত থাকবে কি"? তিনি এখান থেকে এই দুর্মূল্য মুর্তি পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও করেছেন। মূর্তির কথা জানতে পেরে গত মঙ্গলবার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া একটি চিঠি পাঠান রাজ্যের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জেনারেলের দফতরে। তারা মূর্তিটি সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি পুরুলিয়া জেলাশাসকের কাছেও সেই চিঠির প্রতিলিপি পাঠান। আপাতত মূর্তিটি উদ্ধার করে পুরুলিয়া মফস্সল থানায় রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি কেউই। পুরুলিয়া মফস্সল থানা ও জেলা পুলিশ সুপারের দফতরে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, এটা পুলিশের কাজ নয়। জেলাশাসক উদ্ধারের নির্দেশ দেওয়ার পরে পুলিশ প্রয়োজনীয় সাহায্য করবে। কানাডার মাটিতে দুর্গাপুজো | একত্রিত বাঙালিরা
পুরুলিয়ার জেলাশাসক রজত নন্দর দফতরের পক্ষে জানিয়ে দেওয়া হয় বিষয়টি দেখছে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ। জেলাশাসক নিজেও মোবাইলে মেসেজ করে তা জানান। এর পরে জেলা তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী জানান, মূর্তিটি উদ্ধারের উদ্যোগ নিলেও বাধা পেতে হচ্ছে। কিন্তু কেন গ্রামবাসীরা ওই মূর্তি দিতে চাইছেন না? স্থানীয় তৃণমূল নেতা সিদ্ধার্থ মাহাতোর বক্তব্য, "ইতিহাসের থেকে মানুষের আবেগের গুরুত্ব বেশি। গ্রামের মানুষেরা দিনরাত হন্যে হয়ে পড়ে রয়েছেন মূর্তির সামনে। যিনি প্রথম দেখেছিলেন তিনি সেই থেকে হবিষ্যান্ন খাচ্ছেন। সকাল, সন্ধ্যায় মানুষ আরতি দেখতে আসছেন, ভোগ দিচ্ছেন, মানত করছেন। এর কি কোনও মূল্য নেই? স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ হারকিল আনসারি বলেন, "পাবলিক ওটাকে দিতে চাইছে না। গোলামারা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার নবকুঞ্জ কমিটি মন্দিরের পক্ষে কোনও একটি সংস্থা মন্দির বানিয়ে দেবে বলেছে।
নবকুঞ্জের সদস্য প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, "আমরা কেউ কেউ বুঝছি। কিন্তু সবাই তো বুঝছে না। সকলে ভক্তি ভরে পুজো করছে। সেটাকেও তো মান্যতা দিতে হবে। মানুষ আর মানুষের আবেগ নিয়েই তো সমাজ। পরিস্থিতি যে ক্রমশই ঘোরালো হয়ে উঠছে তা মানছেন পুরুলিয়া ২ ব্লকের বিডিও দেবজিৎ রায়। তিনি বলেন, "আমি নিজে গোলামারায় গিয়েছিলাম। ঘেরাও করে রেখেছিল। গ্রামের মানুষ মনে করছেন এই মূর্তি আসার ফলে অনেককিছু শুভ হয়েছে। তাই তাঁরা বলছেন, জীবন দেব, কিন্তু মূর্তি দেব না।" দেবজিৎ মনে করেন, মূর্তি উদ্ধার করতে হলে সবার আগে প্রশাসনের শীর্ষ মহলকে এসে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দরকারে রাজ্য ও জাতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কর্তাদেরও গ্রামে এসে এই মূর্তির ঐতিহাসিক মূল্য বোঝাতে হবে। উপর মহল কবে উদ্যোগী হবেন জানা নেই। তবে এই মূর্তি যাদের হাতে থাকার কথা সেই রাজ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল দফতরের কর্তা বিপ্লব রায়ের আশঙ্কা, প্রশাসন এখনই তৎপর না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, "দুর্গাপুজোর দ্বিতীয়ার দিনে উদ্ধার হওয়া মূর্তি পঞ্চমীতে দেবতা হিসাবে চার দিন পুজো পেয়ে গিয়েছেন। দেবীপক্ষের মধ্যেই হয়তো তিনি জাগ্রত হয়ে উঠবেন। তার পরে নতুন দেবতার নতুন মন্দিরের শিল্যান্যাসের ঘোষণও হয়তো হয়ে যাবে। ভক্তের মন্দিরে বন্দি হয়ে থেকে যাবে ইতিহাস"। তিনি আরও বলেন, "এই মূর্তি জাতীয় সম্পত্তি। অবিলম্বে এটি উদ্ধারে প্রশাসনিক উদ্যোগ দরকার। সেটা না হলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে"। ইভিএম নিউজ