ব্যুরো নিউজ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : আজ ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ ৭৫ বছর পূর্ণ করলেন। এই বিশেষ দিনে বিশ্বজুড়ে তাঁর সমর্থক এবং ভারতজুড়ে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এই দিনটি উদযাপন করছে। গুজরাটের ভাদনগরে ১৯৫০ সালের এই দিনে জন্ম নেওয়া নরেন্দ্র মোদী, জীবনের এক সাধারণ স্তর থেকে উঠে এসে ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের একজন হয়েছেন।
একটি সাধারণ জীবন থেকে দেশের শীর্ষ পদে
নরেন্দ্র মোদীর জীবনের গল্প অসাধারণ উত্থানের এক প্রতিচ্ছবি। গুজরাটের মেহসানা জেলায় জন্মগ্রহণকারী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীকে প্রায়শই তাঁর বাবা-কে রেল স্টেশনে চা বিক্রি করতে সাহায্য করতে দেখা যেত। এই বিনয়ী সূচনা তাঁর বর্তমানের বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে ভূমিকার সম্পূর্ণ বিপরীত। ২০০১ সালে তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তী ১৩ বছর রাজ্যের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের তত্ত্বাবধান করেন। তাঁর “গুজরাট মডেল” জাতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করে।
২০১৪ সালে বিজেপি নির্বাচনে জয়লাভের পর মোদী প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি স্বচ্ছ ভারত অভিযান, মেক ইন ইন্ডিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনা-এর মতো উচ্চমানের জনমুখি প্রকল্পগুলি চালু করেন। ২০১৯ সালে তিনি আরও বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ফিরে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে তৃতীয় স্থানে পৌঁছানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
PM Modi : মার্কিন শুল্ক দ্বিচারিতার মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘স্বদেশী’ বার্তা !
অভূতপূর্ব রেকর্ড ও মাইলফলক
প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য রেকর্ড স্থাপন করেছেন।
- দীর্ঘতম কার্যকালের অবিচ্ছিন্ন প্রধানমন্ত্রী (অ-কংগ্রেসী): ২০২৫ সালের ২৪শে জুলাই, মোদী ৪,০৭৮ দিন একটানা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ইন্দিরা গান্ধীর ৪,০৭৭ দিনের রেকর্ড ভেঙে দেন। তিনি এখন জওহরলাল নেহেরুর পরে এক টানা দ্বিতীয় দীর্ঘতম কার্যকালের প্রধানমন্ত্রী।
- স্বাধীনতার পর জন্ম নেওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী: নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর জন্মগ্রহণ করেছেন।
- তিনটি সাধারণ নির্বাচনে জয়ী প্রথম অ-কংগ্রেস নেতা: ২০১৪, ২০১৯ এবং ২০২৪ সালে টানা তিনটি লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি জওহরলাল নেহেরু এবং ইন্দিরা গান্ধীর মতো নির্বাচিত ভারতীয় নেতাদের অভিজাত গ্রুপে স্থান পেয়েছেন।
- সর্বাধিক আন্তর্জাতিক সম্মান: প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার এবং বেসামরিক সম্মান পেয়েছেন। এ পর্যন্ত ১৮টি দেশ তাঁকে তাদের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানে ভূষিত করেছে।
- পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরা: ইন্দিরা গান্ধীর পর নরেন্দ্র মোদী প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন।
স্লোগান ও উক্তি: ভাষা থেকে আন্দোলনে রূপান্তর
প্রধানমন্ত্রী মোদীর রাজনৈতিক যাত্রায় তাঁর স্লোগান এবং উক্তিগুলি শুধু শব্দ নয়, বরং গণসংহতি, জাতীয় গর্ব এবং সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে কাজ করে। তাঁর সংক্ষিপ্ত বাক্য, স্মরণীয় চিত্র এবং ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণ ভারতীয় রাজনৈতিক যোগাযোগের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছে।
- ‘সেবা’ হিসেবে ক্ষমতা: গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি বলেন, “यह तीन हजार दिन तक सेवा करने का अवसर नरेन्द्र मोदी के कारण नहीं है… यह जनता-जनार्दन के आशीर्वाद के कारण है।” (এই তিন হাজার দিন ধরে সেবা করার সুযোগ নরেন্দ্র মোদীর কারণে নয়… এটা জনগণের আশীর্বাদের কারণে।)
- প্রধানমন্ত্রী নয়, ‘প্রধান সেবক’: ২০১৪ সালের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তিনি বলেন, “मैं प्रधानमंत्री नहीं, प्रधान सेवक हूँ।” (আমি প্রধানমন্ত্রী নই, প্রধান সেবক।)
- ‘Vocal for Local’: “एक ही मंत्र ‘Vocal for Local’, एक ही रास्ता ‘आत्मनिर्भर भारत’, एक ही लक्ष्य ‘विकसित भारत’।” (একটিই মন্ত্র ‘ভোকাল ফর লোকাল’, একটিই পথ ‘আত্মনির্ভর ভারত’, একটিই লক্ষ্য ‘বিকশিত ভারত’)।
- শিক্ষাই দারিদ্র্য মুক্তির হাতিয়ার: “गरीबी के सामने लड़ने का उत्तम हथियार शिक्षा है।” (দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সেরা অস্ত্র হলো শিক্ষা।)
- গণতন্ত্র এক জীবনশৈলী: “भारत में लोकतंत्र एक प्रणाली नहीं, यह जीवन शैली है।” (ভারতে গণতন্ত্র শুধু একটি ব্যবস্থা নয়, এটি একটি জীবনশৈলী।)
- নারী শক্তি: “नारी शक्ति हमारे हर प्रयास की अग्रणी है।” (নারী শক্তি আমাদের প্রতিটি প্রচেষ্টার অগ্রভাগে।)
- অপারেশন সিন্দুর (২০২৫): “ऑपरेशन सिंदूर ने आतंक के खिलाफ लड़ाई में एक नई लकीर खींच दी है, एक नया पैमाना तय कर दिया है… हम आतंक की पैरवी करने वाली सरकार और आतंक के आकाओं को अलग-अलग नहीं देखेंगे।” (অপারেশন সিন্দুর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি নতুন রেখা টেনে দিয়েছে, একটি নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে… আমরা সন্ত্রাসকে সমর্থনকারী সরকার এবং সন্ত্রাসের হোতাদের আলাদা করে দেখব না।)
PM Modi : কৃষক-মৎস্যজীবীদের স্বার্থে , “চড়া মূল্য দিতে প্রস্তুত” । ট্রাম্পের শুল্কের মুখে অনড় মোদী
সাধারণ মানুষের জীবনে পরিবর্তন
গত এক দশকে বেশিরভাগ ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবন উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের টিকিট কাটা বা দোকানে খুচরা টাকার জন্য অপেক্ষা করা থেকে এক ক্লিকে পেমেন্ট এবং অনলাইনে টিকিট বুকিং করার সুবিধা এসেছে। ২০১৪ সালের তুলনায় মোদী যুগে সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
তাঁর সরকারের নীতিগুলি সাধারণ ভারতীয়দের জীবনকে নতুন করে সাজিয়েছে:
- UPI ও ডিজিটাল পেমেন্ট: ২০১৬ সালে চালু হওয়া ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস (UPI) অনলাইন পেমেন্টকে সহজ করেছে।
- জন ধন অ্যাকাউন্ট: ২০১৪ সালের ২৮শে আগস্ট চালু হওয়া প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনা কোটি কোটি মানুষকে, বিশেষ করে নারীদের, আর্থিক স্বাধীনতা দিয়েছে।
- ফাস্ট্যাগ ও পরিবহন দক্ষতা: টোল প্লাজার লম্বা লাইন কমেছে, যা সময় ও জ্বালানি সাশ্রয় করে।
- সস্তা ডেটা ও ইন্টারনেট: সাশ্রয়ী ইন্টারনেট ছোট শহর এবং গ্রামগুলিতে অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করেছে।
- মেট্রো বিস্তার: মেট্রো শহরের ট্রাফিক সমস্যা কমিয়ে দিয়েছে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।
- জন ঔষধি কেন্দ্র: সাশ্রয়ী মূল্যে জেনেরিক ওষুধ সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করেছে।
- ডিজিলকার ও ই-গভর্নেন্স: কাগজপত্রের ঝামেলা কমেছে এবং ডিজিটাল যাচাইকরণ সহজ হয়েছে।
- QR কোড: ছোট দোকানদারদের আর্থিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
- গিগ ইকোনমি: লাখ লাখ মানুষের জন্য নমনীয় কাজের সুযোগ তৈরি করেছে।
- সরাসরি বেনিফিট ট্রান্সফার: মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে সরাসরি নাগরিকদের কাছে অর্থ পৌঁছে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর কাজ, কর্মসংস্থান, শৃঙ্খলা এবং সাধারণ জীবনযাত্রা প্রশংসিত। তাঁর সমালোচকরাও তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতা এবং দলকে নির্বাচনী সাফল্যের দিকে চালিত করার ক্ষমতাকে স্বীকার করেন।
শুভ জন্মদিন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।