Vice President vs Jamait Ulema Vande Mataram

ব্যুরো নিউজ, ০৯ই ডিসেম্বর ২০২৫ : মঙ্গলবার রাজ্যসভার চেয়ারম্যান সি.পি. রাধাকৃষ্ণন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উদ্যোগে উচ্চ কক্ষে বন্দে মাতরম নিয়ে নির্ধারিত বিতর্কের আগে জাতীয় সঙ্গীতটির “গভীর তাৎপর্য” তুলে ধরেন। তিনি বন্দে মাতরমকে নিছক একটি জাতীয় গান হিসেবে নয়, বরং “জাতির স্পন্দন” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

রাধাকৃষ্ণন বলেন, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত এই গানটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের “অটল সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস” হিসেবে কাজ করেছে। তিনি গানটিকে “আমাদের জাতির স্পন্দন – অসংখ্য মায়ের অব্যক্ত প্রার্থনা, নিপীড়িতদের নিঃশব্দ আশা, এবং যারা একদিন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে সাহস জুগিয়েছিল, তাদের অটল সাহস” বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, এটি “মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছুক লক্ষ লক্ষ মানুষের সম্মিলিত হৃদস্পন্দন” হয়ে উঠেছিল। তিনি আরও বলেন, “অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর কাছে, ‘বন্দে মাতরম’ কেবল একটি গান ছিল না, ফাঁসির মঞ্চের দিকে নির্ভয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাদের হৃদয় থেকে উচ্চারিত শেষ মন্ত্র ছিল, তাদের আত্মা এক স্বাধীন ভারতের স্বপ্নে আলোকিত ছিল।” মহাকবি সুব্রামানিয়া ভারতীর উক্তি উদ্ধৃত করে তিনি গানটির দূরপ্রসারী দেশপ্রেমিক প্রভাবের উপরও জোর দেন।

গানটির ১৫০ বছর পূর্তি উদযাপনকে জাতীয় প্রতিজ্ঞার আহ্বান হিসেবে উল্লেখ করে রাধাকৃষ্ণন বলেন, বন্দে মাতরম ভারতের “পরিচয়, ঐক্য এবং ভাগ করা ভাগ্যের প্রতি একটি solemn vow” বা পবিত্র অঙ্গীকার। তিনি দেশবাসীকে “সততার সাথে সেবা করতে, এক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং গর্বের সাথে বন্দে মাতরম ঘোষণা করতে” আহ্বান জানান।

জমিয়ত প্রধানের আপত্তি: “সম্পূর্ণ গান ইসলামি বিশ্বাসের পরিপন্থী”

অন্যদিকে, জমিয়ত উলেমা-এ-হিন্দের সভাপতি মাওলানা আরশাদ মাদানি একটি ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “মুসলমানরা বন্দে মাতরমের সম্পূর্ণ সংস্করণটি পাঠ করতে পারে না”, কারণ গানটির বেশ কিছু শ্লোক ইসলামি বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। মাওলানা মাদানি ব্যাখ্যা করেন, বন্দে মাতরমের অংশবিশেষে দেশকে “দুর্গামাতা” রূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এতে পূজার সাথে সম্পর্কিত অভিব্যক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর যুক্তি, ইসলামে একমাত্র আল্লাহর উপাসনার অনুমতি আছে এবং অন্য কারও পূজা করা ইসলামি নীতির পরিপন্থী। তিনি বলেন, “আমরা মৃত্যুকে মেনে নিতে পারি, কিন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করব না।”

Vande Mataram : বঙ্কিমচন্দ্রের রচিত ‘রণহুঙ্কার’ নিয়ে সংসদে বিশেষ বিতর্ক; কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর।

সংবিধান ও ধর্মীয় স্বাধীনতার উল্লেখ:

জমিয়ত প্রধান জোর দিয়ে বলেন যে ভারতীয় সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতার (ধারা ২৫) এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার (ধারা ১৯) নিশ্চয়তা দেয়। তিনি সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণও উল্লেখ করেন যে “কোনও নাগরিককে তার বিশ্বাসের পরিপন্থী কোনও গান গাইতে বা বলতে বাধ্য করা যায় না।” মাদানি মনে করেন, বন্দে মাতরম নিয়ে বিতর্ক অবশ্যই সাংবিধানিক অধিকার এবং পারস্পরিক সম্মানের সীমার মধ্যে থাকতে হবে, এটিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করা উচিত নয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুপারিশ:

ঐতিহাসিক নথিপত্র উল্লেখ করে মাদানি স্মরণ করিয়ে দেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৭ সালে জওহরলাল নেহেরুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বন্দে মাতরমের শুধুমাত্র প্রথম দুটি স্তবক জাতীয় গান হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, কারণ বাকি পদগুলি একেশ্বরবাদী ধর্মের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে। এই সুপারিশের ভিত্তিতেই কংগ্রেস কার্যনির্বাহী কমিটি কেবল প্রথম দুটি স্তবক অনুমোদন করেছিল। মাদানির দাবি, সম্পূর্ণ গানটি পাঠের ন্যায্যতা দিতে আজ ঠাকুরের নাম ব্যবহার করা ঐতিহাসিক তথ্যের পরিপন্থী।

Vande Mataram 150 years : বন্দে মাতরমের ১৫০ বছর পূর্তি: মোদীর উদযাপনে দেশজুড়ে ‘পূর্ণ সংস্করণের’ স্বাধিনতার মন্ত্র , দেবী দুর্গা বন্দনার অংশ বাদ দেওয়া বিতর্কে কংগ্রেসকে তীব্র আক্রমণ বিজেপির

সম্পাদকীয় মন্তব্য: বিভাজনের রাজনীতি ও জাতীয় আনুগত্যের প্রশ্ন

রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এবং জমিয়ত প্রধানের এই “সুস্পষ্ট মতপার্থক্য” দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় আনুগত্য এবং ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেকার চিরন্তন দ্বন্দ্ব আবার প্রকাশ্যে এনেছে। চেয়ারম্যান যেখানে বন্দে মাতরমকে “জাতীয় জীবনের প্রতিজ্ঞা” এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের “শেষ উচ্চারণ” হিসেবে দেখছেন, সেখানে জমিয়ত প্রধান ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে “সম্পূর্ণ গানটি পাঠে” সাংবিধানিক অধিকারের ভিত্তিতে আপত্তি জানাচ্ছেন।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, এই বিতর্ক দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামো এবং আস্থা-ভিত্তিক মেরুকরণের রাজনীতিকে নতুন করে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। একদিকে যখন দেশের একটি বৃহৎ অংশ মাতৃভূমির প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশে বন্দে মাতরমে শপথ নিচ্ছে, তখনও জনসংখ্যার একটি অংশ ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে জাতির ঊর্ধ্বে স্থান দিচ্ছে বলে মন্তব্য উঠে আসছে। এই পরিস্থিতিই ইঙ্গিত দেয় যে, সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও, ভারতে বিশ্বাস-ভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতি হয়তো কখনোই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর