ব্যুরো নিউজ ১২ জুন : একদিকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সন্ত্রাস দমনে ‘অসাধারণ অংশীদার’ বলে ভূয়সী প্রশংসা করছে, ঠিক তখনই বালোচ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ)-এর নেতা আল্লাহ নজার বালোচ অভিযোগ তুলছেন যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ‘আইএসআইএস-খোরাসান (আইএসআইএস-কে)’ এর আখ্যানটি তৈরি এবং প্রচার করছে। এই পরস্পর বিরোধী চিত্র যেন এক ভূ-রাজনৈতিক কমেডি, যার আড়ালে চলছে বালোচিস্তানের রক্তক্ষয়ী বাস্তবতার নির্মম মঞ্চায়ন।
পাকিস্তানি নাটকের চিত্রনাট্য
আইএসআইএস-কে বনাম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন
আল্লাহ নজরের বিস্ফোরক অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মিডিয়া শাখা, ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (ISPR) এর ‘সাজানো চিত্রনাট্য’ হলো আইএসআইএস-কে-এর মতাদর্শগত ভিত্তি। তার মতে, এর মূল লক্ষ্য হল ধর্মকে হাতিয়ার করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে অবৈধ প্রমাণ করা এবং বিদেশী শক্তির প্রক্সি হিসেবে মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত করে জনমতকে প্রভাবিত করা। অর্থাৎ, যখনই বালোচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য কোন বৈধ আন্দোলন মাথা চাড়া দেয়, তখনই সেখানে আইএসআইএস-কে নামক এক ‘কাল্পনিক’ দৈত্যকে হাজির করা হয়, যাতে বিশ্বের কাছে বালোচদের ন্যায্য দাবিকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে চিত্রিত করা যায়।
নজর জোর দিয়ে বলেছেন যে, বালোচদের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় সংগ্রাম একটি ‘জনগণের আন্দোলন’, যা শুধুমাত্র বালোচ জনগণ দ্বারা সমর্থিত এবং বিদেশী শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। এটিকে তিনি ‘জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রকৃত প্রকাশ’ বলে অভিহিত করেছেন। তার অভিযোগ, পাকিস্তান পদ্ধতিগতভাবে বালোচ সমাজকে অবমানিত করার চেষ্টা করছে, যাতে তাদের জাতীয় পরিচয় মুছে ফেলা যায় এবং বালোচিস্তানকে একটি স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করা যায়। বালোচিস্তানের নিরাপত্তা কাঠামো সরাসরি সামরিক বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, বেসামরিক সরকারের দ্বারা নয়, এমন অভিযোগও তিনি করেছেন। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আঞ্চলিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা জিঁইয়ে রাখতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগও তুলেছেন তিনি।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
মার্কিন প্রশংসার আড়ালে রক্তস্নাত বাস্তবতা
এরই মধ্যে, মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (CENTCOM) প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলা একটি শুনানিতে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাস দমনে একটি অসাধারণ অংশীদার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ওয়াশিংটনকে নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদ/রাওয়ালপিন্ডি উভয়ের সঙ্গেই একটি শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, কারণ এই সমীকরণ দ্বৈত হতে পারে না। তিনি আরও যোগ করেছেন যে, আমেরিকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের এই অঞ্চলে একটি অংশীদার হিসেবে থাকা অত্যন্ত জরুরি।
জেনারেল কুরিলা বলেছেন যে, আইএসআইএস খোরাসান বিশ্বব্যাপী, এমনকি নিজ দেশের বিরুদ্ধেও বহিরাগত চক্রান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেছেন যে, তালেবানরা বর্তমানে আইএসআইএস-কে-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং তারা একে অপরকে ঘৃণা করে। কুরিলা পাকিস্তানের ‘অসাধারণ অংশীদার’ হিসেবে প্রশংসা করে বলেছেন যে, সীমিত মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তান কীভাবে আইএসআইএস-কে-এর বিরুদ্ধে ‘সক্রিয় সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই’ চালাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান মুনির তাকে জানিয়েছেন, ‘আমি তাকে (জাফর) ধরেছি এবং আমরা তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করতে যাচ্ছি। দয়া করে প্রতিরক্ষা সচিব এবং প্রেসিডেন্টকে বলুন।’ কুরিলা বলেন, “আমরা দেখছি পাকিস্তান, আমরা তাদের যে সীমিত গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছি, তা দিয়ে আইএসআইএস-কে-এর বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব উপায়ে অভিযান চালাচ্ছে – এবং আমরা দেখছি এর প্রভাব আইএসআইএস-খোরাসানের উপর পড়েছে।”
তবে, এই মার্কিন প্রশংসার আড়ালে বালোচিস্তানে চলছে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। বালোচ জনগণ বহু আইন, বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং বিশেষ নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অপব্যবহারের মাধ্যমে পদ্ধতিগত নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এই আইনগুলির অধীনে নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়শই ব্যাপক ক্ষমতা এবং আইনি অনাক্রম্যতা নিয়ে কাজ করে, যার ফলে ব্যাপক হারে জোরপূর্বক গুম, বিচার ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদী আটক এবং মৌলিক আইনি অধিকার অস্বীকারের খবর পাওয়া যায়। সামরিক আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলি প্রায়শই বালোচ কর্মীদের ন্যায্য বিচার ছাড়াই বিচার করে, যা তাদের বিচার পাওয়ার সুযোগ আরও সীমিত করে। উপরন্তু, মিডিয়া সেন্সরশিপ আইনগুলি বালোচ কণ্ঠকে দমন করে এবং এই অপব্যবহারগুলিকে জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখে, যার ফলে বালোচ জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং দায়মুক্তির এক চক্র অব্যাহত রয়েছে।
ভারতের উদ্বেগের আড়ালে ভূ-রাজনৈতিক চতুরতা
জেনারেল কুরিলার মন্তব্য এসেছে ভারতের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক আক্রমণের প্রেক্ষাপটে, যেখানে ভারত পাকিস্তানকে সীমান্ত সন্ত্রাসবাদের জন্য দায়ী করতে চাইছে। কুরিলা ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে সওয়াল করে বলেছেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার নীতিকে শূন্য-সমষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়। এর মাধ্যমে তিনি যেন বোঝাতে চাইছেন, ভারতের উদ্বেগের পাশাপাশি পাকিস্তানের ‘ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব’ও আমেরিকার কাছে কম নয়।
যখন এক হাতে পাকিস্তান ‘সন্ত্রাস দমনের’ প্রশংসা কুড়োচ্ছে, অন্য হাতে তারা নিজেদের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাকে নিষ্পেষণ করছে এবং তাদের ‘সাজানো নাটকে’ আইএসআইএস-কে নামক দানবকে ব্যবহার করছে, যার শেষ পরিণতি হয় বালোচদের দীর্ঘশ্বাস আর আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা।