ব্যুরো নিউজ ২৯ জুন: কসবায় কলেজের ভিতরে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের অস্বস্তি আরও বাড়ল। এবার দলের বর্ষীয়ান নেতা এবং কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্রকে ‘শো কজ়’ করল তৃণমূল। বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে নেওয়া হল কড়া সাংগঠনিক পদক্ষেপ। দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর পাঠানো চিঠিতে তিন দিনের মধ্যে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে মদনের কাছে।
শুধু মদনই নন, এই ঘটনার পর কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যও ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে। তবে কল্যাণের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও ‘শো কজ়’ না গেলেও, দলের তরফে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে— এই ধরনের মন্তব্য ব্যক্তিগত, এবং তা দলের অবস্থানকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তৃণমূলের বার্তা পরিষ্কার— “জিরো টলারেন্স”।
কী মন্তব্য করেছিলেন মদন?
মদন মিত্র সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ছাত্রীটি একা কলেজে না গেলে এই ঘটনা ঘটত না। সে কেন একা গেল? কেন সঙ্গে বন্ধুবান্ধব বা বাবা-মাকে নিল না? এটা একেবারে ফাঁকা কলেজে ঘটেছে, যার সুযোগ নিয়েছে অভিযুক্তরা।” তিনি আরও বলেন, “আপনি জানতেন পরীক্ষার সময়, কলেজ বন্ধ, কেউ নেই। আপনি কী জন্য গেলেন? আপনি বলছেন প্রেমিককে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, ধর্ষণ করা হয়েছে। তাহলে কেন সতর্কতা নিলেন না?”
এই মন্তব্য জনমানসে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। প্রশ্ন ওঠে— ধর্ষণের মতো ভয়ানক অপরাধে নির্যাতিতার ‘চালচলন’ বা সিদ্ধান্তকে কেন কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে?
মুম্বইয়ের বহুতল আবাসনের ১৭ তলা থেকে পথ কুকুরের ঝাঁপ, অভিযুক্ত আবাসনের নিরাপত্তাকর্মী
শনিবার রাতেই দল একটি বিবৃতি দিয়ে জানায়— মদনের (এবং কল্যাণের) মন্তব্য একান্তই ব্যক্তিগত, এবং দল সেই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয়। এর পরদিনই আসে আরও কড়া বার্তা। মদনের নামে পাঠানো চিঠিতে লেখা হয়, “আপনার অযাচিত ও অসংবেদনশীল মন্তব্য দলের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে। এটি দলের কঠোর অবস্থানের পরিপন্থী এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল।”
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, “কসবায় একটি মর্মান্তিক অপরাধ ঘটেছে। দোষীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু আপনি যে মন্তব্য করেছেন তা অত্যন্ত অনভিপ্রেত এবং জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়।”
কল্যাণেরও বিতর্কিত মন্তব্য
শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন, “যদি সহপাঠীই ধর্ষণ করে, তাহলে নিরাপত্তা কে দেবে?” এই মন্তব্যও সমালোচিত হয়। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন— একজন আইনজীবী এবং সাংসদ হয়ে কল্যাণ কীভাবে এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারেন?
মহিলা সাংসদ মহুয়া মৈত্র তৃণমূলের তরফে প্রকাশিত বিবৃতি শেয়ার করে জানান— “নারীবিদ্বেষ কোনও দলের সীমায় বাঁধা নেই, তবে তৃণমূলের বিশেষত্ব হল, আমরা এই ধরনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করি— তা সে যত বড় নেতাই করুন না কেন।” তিনি কারও নাম না করলেও, তাঁর বার্তায় কল্যাণ ও মদনের প্রতি তীব্র অসন্তোষ স্পষ্ট।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শাসকদলের উদ্বেগ
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন যত এগোচ্ছে, ততই তৃণমূল চেষ্টা করছে জনমতের পাশে দাঁড়াতে। সেই জায়গায় এমন একটি ঘটনাকে ঘিরে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুখ খুলে পড়েছেন দলেরই মহিলা সাংসদরা। কল্যাণ ও মহুয়ার পুরনো বিরোধের ছায়া এ দিন আরও গাঢ় হয়েছে।
তৃণমূলে রক্তগরম রাজনীতি ফের প্রকাশ্যে!
একদিকে ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে দল বলছে ‘জিরো টলারেন্স’, অন্যদিকে দলের জনপ্রিয় বিধায়ক ও সাংসদদের মন্তব্য সেই অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। স্বাভাবিক ভাবেই, এই দ্বৈত বার্তা নিয়ে জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। দলের অনেকেই বলছেন, এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের উচিত ছিল দু’জনের বিরুদ্ধেই সমান কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় এবার তৃণমূলকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। কসবা-কাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায় মন্তব্য করার আগে নেতা-নেত্রীদের আরও সংযত হওয়া প্রয়োজন। নয়তো বিরোধীরা এর রাজনৈতিক ফায়দা তুলবে— যা ২০২৬-এর ভোটে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।সামাজিক মাধ্যমে #ShameOnMadon এবং #JusticeForKasbaVictim ট্রেন্ড করছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন— “একটি মেয়ে একা কোথাও গেলে কী তার নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সমাজের নয়?” বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এই মন্তব্যগুলো শুধু রাজনৈতিক ভাবে নয়, সামাজিক ভাবেও বিপজ্জনক।মদন মিত্রকে শো কজ় করা নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, তবে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য নিয়েও দল কী অবস্থান নেয়, সেটির দিকে এখন নজর রাখছে রাজ্য রাজনীতি। তৃণমূলের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে হলে, দলীয় স্তরে আরও দৃঢ়তা ও একাধিকস্তরীয় পদক্ষেপ প্রয়োজন।