ব্যুরো নিউজ ১০ জুন : মুম্বাইয়ের জনবহুল উপনগরী রেল নেটওয়ার্কে আবারও ঘটল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। সোমবার সকালে থানে জেলার মুম্বরার কাছে একটি অতিরিক্ত ভিড়ে ঠাসা ট্রেন থেকে পড়ে অন্তত পাঁচজন যাত্রী নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনা মুম্বাইয়ের ব্যস্ত লোকাল ট্রেনের যাত্রী নিরাপত্তা এবং অতিরিক্ত ভিড়ের দীর্ঘদিনের সমস্যাকে নতুন করে সামনে এনেছে।
দুর্ঘটনার বিবরণ
সেন্ট্রাল রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘটেছিল দিভা এবং কোপার রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী ডাউন/ফাস্ট লাইনে। অতিরিক্ত ভিড়ে ঠাসা একটি কাসারা-গামী লোকাল ট্রেন যাচ্ছিল, সেই সময় ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা পরস্পরকে ধাক্কা খেয়ে বা বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে লাইনে ছিটকে পড়েন। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের মতে, দুর্ঘটনার মূল কারণ অতিরিক্ত ভিড়। সকাল ৯:৩০ নাগাদ কাসারা-গামী একটি লোকাল ট্রেনের গার্ড প্রথম লাইনের পাশে আহত যাত্রীদের পড়ে থাকতে দেখেন এবং নিয়ন্ত্রণ কক্ষে খবর দেন।
নিহত ও আহতদের তথ্য
এই দুর্ঘটনায় অন্তত পাঁচজন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন:
- কেতন দিলীপ সরোজ (পুরুষ, ২৩ বছর, উলহাসনগর নিবাসী)
- রাহুল সন্তোষ গুপ্তা
- ভিকি বাবসাহেব মুখিদাল (পুরুষ, ৩৪ বছর, রেলওয়ে পুলিশ কর্মচারী)
- এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি
এছাড়াও, ১৩ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। আহতদের দ্রুত নিকটস্থ ছত্রপতি শিবাজি হাসপাতাল (শিয়াজি হাসপাতাল) এবং থানে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, যেখানে তাদের চিকিৎসা চলছে। আহতদের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্টে আটজনের কথা বলা হলেও, পরে অন্তত ছয়জনের রেললাইনের পাশে আহত অবস্থায় থাকার খবর আসে।
রেল কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক বক্তব্য ও কারণ বিশ্লেষণ
সেন্ট্রাল রেলওয়ের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক (CPRO) স্বপ্নিল ধনরাজ নীলা জানান, “মুম্বরা থেকে দিভার দিকে যাতায়াতকারী লোকাল ট্রেন থেকে আটজন যাত্রী পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।” তিনি আরও জানান, কাসারার দিকে যাওয়া লোকাল ট্রেনের গার্ড এই ঘটনার কথা জানান। যদিও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে যাত্রীরা কোন নির্দিষ্ট ট্রেন থেকে পড়েছেন, তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সিআরও মন্তব্য করেন যে, এটি দুটি ট্রেনের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ ছিল না। বরং, বিপরীতমুখী দুটি ট্রেনের ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ছিটকে যান। তিনি উল্লেখ করেন যে, ট্রেনের ভেতর জায়গা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় যাত্রীরা ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করেন। দুটি ট্রেনের মধ্যে ১.৫-২ মিটার দূরত্ব থাকলেও বাঁকগুলিতে সামান্য হেলে যাওয়ার কারণে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
রাজনৈতিক চাপানউতর
মুম্বাই লোকাল ট্রেনের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করে রেল বিভাগকে ঘটনার সঠিক কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে মহা বিকাশ আঘাদি (MVA)-এর নেতা, যেমন কংগ্রেস, উদ্ধব ঠাকরে-নেতৃত্বাধীন শিবসেনা এবং শরদ পাওয়ার-নেতৃত্বাধীন এনসিপি (NCP), রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের পদত্যাগ দাবি করেছে। তারা অভিযোগ করেন যে, এই ঘটনা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবকে উন্মোচন করেছে।
- কিশোরী পেডনেকর (প্রাক্তন মুম্বাই মেয়র, শিবসেনা): রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন।
- আদিত্য ঠাকরে (শিবসেনা বিধায়ক): বলেন, “এই ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক, তবে নতুন নয়। তিনি রেলমন্ত্রী নাকি ‘রিল মিনিস্টার’ তা বোঝা মুশকিল। তিনি রেলওয়ের আসল সমস্যায় মনোযোগ দেন না।”
- বর্ষা গায়কোয়াড (মুম্বাই কংগ্রেস সভাপতি): মুম্বাইয়ের ট্রেন নেটওয়ার্কে নিরাপত্তার অভাব পুনরায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ভিড় ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সঠিক নীতির এবং তদন্তের দাবি করেন।
- সুপ্রিয়া সুলে (এনসিপি এমপি): অত্যন্ত ভিড়ের কারণে যাত্রীরা ট্রেনের দরজায় ঝুঁকে যাতায়াত করছিলেন উল্লেখ করে নাগরিকদের বিপজ্জনকভাবে ভ্রমণ না করার অনুরোধ করেন এবং রেল প্রশাসনকে ভিড় নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে বলেন।
- প্রকাশ আম্বেদকর (বঞ্চিত বহুজন আঘাদি প্রতিষ্ঠাতা): ভারতীয় রেলের যাত্রী সুরক্ষার প্রতি অবহেলার অভিযোগ এনে পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং জবাবদিহিতার দাবি জানান।
- রুবেল মাস্কারেনহাস (এএপি মুম্বাই কার্যনির্বাহী সভাপতি): প্রতিদিন মুম্বাই উপনগরী রেলওয়ে সিস্টেমে গড়ে সাতজনের মৃত্যুর ঘটনাকে “জাতীয় লজ্জা” বলে আখ্যা দেন এবং রেলমন্ত্রীকে “অযোগ্য” বলে মন্তব্য করেন।
- রাজ ঠাকরে (এমএনএস সভাপতি): বহু বছর ধরে শহরের বাইরে থেকে আসা মানুষের ভিড়ে রেলওয়ের বিপর্যস্ত অবস্থার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “শুধুমাত্র মেট্রো চালু করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের দেশে মানুষের কোনো মূল্য নেই।” তিনি কেন্দ্র সরকারের মনোযোগের দাবি জানান।
রেলওয়ের নিরাপত্তা জোরদারে নতুন পদক্ষেপ
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে বোর্ড মুম্বাই উপনগরী রেল নেটওয়ার্কে যাত্রী নিরাপত্তা বাড়াতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের ঘোষণা করেছে। রেলওয়ে বোর্ড এবং ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি (ICF) দলের মধ্যে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের নেতৃত্বে একটি বিস্তারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
গৃহীত প্রধান সিদ্ধান্তগুলি হলো:
- নতুন নন-এসি লোকাল ট্রেন: মুম্বাইয়ের জন্য নতুন ডিজাইনের নন-এসি লোকাল ট্রেন চালু করা হবে, যেখানে স্বয়ংক্রিয় দরজা এবং উন্নত বায়ুচলাচল ব্যবস্থা থাকবে। প্রথম এই ধরনের ট্রেনটি ২০২৫ সালের নভেম্বরের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যাবে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও ছাড়পত্রের পর ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে পরিষেবাতে আনা হবে। এটি মুম্বাই উপনগরী পরিষেবার জন্য বর্তমানে নির্মিত ২৩৮টি এসি ট্রেনের অতিরিক্ত।
- উন্নত বায়ুচলাচল ব্যবস্থা: নন-এসি ট্রেনে স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধের কারণে দমবন্ধ হওয়ার সমস্যা সমাধানের জন্য তিনটি ডিজাইন পরিবর্তন আনা হবে:
- দরজায় Louvres (বায়ু চলাচলের জন্য ব্লেড) থাকবে।
- কোচগুলিতে ছাদের উপর বায়ুচলাচল ইউনিট (roof-mounted ventilation units) থাকবে, যা তাজা বাতাস পাম্প করবে।
- কোচগুলিতে ভেস্টিবুল (vestibules) থাকবে, যাতে যাত্রীরা এক কোচ থেকে অন্য কোচে যেতে পারে এবং ভিড় স্বাভাবিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ হয়।
- বিদ্যমান রেকগুলির আপগ্রেড: বর্তমানে পরিষেবাতে থাকা রেকগুলিকেও পুনরায় ডিজাইন করা হবে যাতে সেগুলিতে স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধের বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এটি যাত্রীদের ফুটবোর্ডে বিপজ্জনকভাবে যাতায়াত করা থেকে বিরত রাখবে।
এই আপগ্রেডগুলির জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা, বাজেট এবং প্রযুক্তিগত বিবরণ এখনও প্রকাশ করা হয়নি, তবে কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন অবিলম্বে শুরু হবে।
দীর্ঘদিনের সমস্যা: অতিরিক্ত ভিড়
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করছে যে, এই দুর্ঘটনার পেছনে মুম্বাইয়ের উপনগরী নেটওয়ার্কের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা—অতিরিক্ত ভিড়—একটি বড় কারণ ছিল। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পিক আওয়ারে যাত্রীর চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ভিড় কমানোর জন্য নতুন পদক্ষেপের মূল্যায়ন করছে। চলমান তদন্তের পাশাপাশি, এই মর্মান্তিক ঘটনাটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত উপনগরী রেল ব্যবস্থার আধুনিক নিরাপত্তা পরিকাঠামোর জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে আবারও তুলে ধরেছে।