ব্যুরো নিউজ, ০৫ই ডিসেম্বর ২০২৫ : ২৩তম ভারত-রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৃহস্পতিবার ভারতে এসেছেন। চার বছর পর এই সফরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রটোকল ভেঙে তাঁকে পালাম বিমানবন্দরে আলিঙ্গন করেন। তবে, এই সফরের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক মুহূর্ত ছিল দুই নেতার একসঙ্গে এক গাড়িতে বিমানবন্দর ত্যাগ করা।
প্রটোকল ভেঙে সাদা টয়োটা ফরচুনারে যাত্রা
সাধারণত প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন উভয়ের জন্যই অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে এবং তাঁরা নিজেদের জন্য বরাদ্দ গাড়িতেই ভ্রমণ করেন। কিন্তু সেই প্রথা ভেঙে দুই নেতা একটি সাদা টয়োটা ফরচুনার সিগমা ফোর এমটি (Sigma 4 MT) মডেলে চড়ে বিমানবন্দর থেকে রওনা হন। গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল “MH01 EN 5795”, যা মহারাষ্ট্রের।
এটি প্রধানমন্ত্রীর গাড়িও ছিল না, এবং বিশ্বের অন্যতম কড়া নিরাপত্তায় থাকা একজন রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রে এই ধরনের সাধারণ গাড়িতে যাত্রা প্রটোকল ভাঙার এক বিরল দৃষ্টান্ত। এই ঘটনাটি ভারত-রাশিয়ার গভীর এবং ব্যক্তিগত সখ্যকেই তুলে ধরেছে।
পুতিনের ‘অভেদ্য দুর্গ’: অরুস সেনেট (Aurus Senat)
সাধারণত, বিদেশ সফরে প্রেসিডেন্ট পুতিন সব সময় তাঁর পছন্দের রাষ্ট্রীয় গাড়ি অরুস সেনেট (Aurus Senat) লিমুজিন ব্যবহার করেন। এই গাড়িটিকে তাঁর ‘সড়কের দুর্গ’ বা ‘রাশিয়ার রোলস-রয়েস’ বলা হয়, যা তাঁর নিরাপত্তার প্রতীক।
অরুস সেনেট-এর বিশেষত্ব:
উৎপাদন: মস্কোর অরুস মোটরস দ্বারা এটি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে। এটি করটেজ (Kortezh) প্রকল্পের অংশ, যা রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তাদের জন্য সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে বিলাসবহুল, সাঁজোয়া যান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল।
শক্তি ও দাম: এটি ৪.৪ লিটার টুইন-টার্বো ভি৮ ইঞ্জিনে চলে, যা প্রায় ৫৯৮ ব্রেক হর্সপাওয়ার শক্তি উৎপাদন করে। এর দাম প্রায় ৫০ মিলিয়ন রুবেল (প্রায় ৫.৬ কোটি টাকা)। ভি১২ হাইব্রিড মডেলও তৈরি হচ্ছে।
নিরাপত্তা: লিমুজিনটি একটি চলন্ত কেল্লার মতো তৈরি। এর সাঁজোয়া বডি বর্ম-ভেদকারী গুলি এবং গ্রেনেড বিস্ফোরণ সহ্য করতে পারে। এতে ৬ সেন্টিমিটার পুরু বুলেটপ্রুফ গ্লাস, রান-ফ্ল্যাট টায়ার, রাসায়নিক আক্রমণের ক্ষেত্রে স্বাধীন অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা এবং একটি অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে। এর বর্ম ভিআর১০ ব্যালিস্টিক মান পূরণ করে।
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারতে এটি পুতিনের প্রথম সফর, তাই এই মুহূর্তে তাঁর প্রটোকল ভেঙে সাধারণ গাড়িতে চড়া যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। এর আগে চিনের তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) শীর্ষ সম্মেলনের পর মোদি এবং পুতিন এই অরুস সেনেটেই এক ঘণ্টারও বেশি সময় কাটিয়েছিলেন।
পুতিনের উড়ন্ত কেল্লা: ‘ফ্লাইং ক্রেমলিন’
প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে তাঁর কাস্টমাইজড রাষ্ট্রীয় বিমান ইলিউশিন আইএল-৯৬-৩০০পিইউ (Ilyushin Il-96-300PU)-তেও ভ্রমণ করেন, যা ‘ফ্লাইং ক্রেমলিন’ নামে পরিচিত। এই বিমানটি জরুরি অবস্থার জন্য নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং একটি পারমাণবিক কমান্ড বোতাম সহ উন্নত নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যে সজ্জিত। বিমানটির অভ্যন্তরটি বিলাসবহুল, যেখানে অফিস, শয়নকক্ষ এবং কনফারেন্স রুম রয়েছে, যা এটিকে আকাশে একটি সম্পূর্ণ ভ্রাম্যমাণ ক্রেমলিন-এ পরিণত করে।
মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির বিমান যেমন ‘ এয়ার ফোর্স ওয়ান ‘ নামে পরিচিত , তেমনই রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির বিমান ‘ উড়ন্ত ক্রেমলিন’ নামে পরিচিত । এই বিমানে করেই পুতিন তার ভারত সফরে আসেন ।
উপসংহার
প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই যৌথ ‘কার মোমেন্ট‘ নিছক প্রটোকল ভাঙার চেয়েও অনেক বেশি কিছু ইঙ্গিত করে। বিশেষত যেখানে বিশ্বের অন্যতম সুরক্ষিত নেতা পুতিন পশ্চিমী দেশগুলিতে এমনকি চিনেও নিজের কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে যান না, সেখানে ভারতে তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার না করে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে একটি সাধারণ গাড়িতে যাত্রা করার পিছনে গভীর বার্তা নিহিত।
এর প্রধান কারণ দুটি বলে মনে করা হচ্ছে:
১. আস্থার বার্তা: পুতিন বিশ্বকে, বিশেষ করে পশ্চিমী বিশ্বকে এই স্পষ্ট বার্তা দিতে চাইলেন যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার বাইরে একমাত্র ভারতে সর্বতোভাবে সুরক্ষিত এবং নিশ্চিন্ত বোধ করেন। এটি দুই দেশের গভীরে প্রোথিত বন্ধুত্ব, বোঝাপড়া এবং একে অপরের প্রতি অটুট ভরসার প্রতীক।
২. গোপন বার্তা আদান-প্রদান: উভয় রাষ্ট্রপ্রধানই হয়তো নিজেদের দেশের নিরাপত্তা প্রোটোকলের আওতার বাইরে এমন কিছু গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ বার্তা আদান-প্রদান করতে চেয়েছিলেন, যা সর্বোচ্চ মন্ত্রকেরও অজানা থাকুক। দুই নেতার নিজস্ব গাড়িতে অত্যাধুনিক নিরাপত্তা প্রযুক্তি থাকায় যে কোনো কথোপকথন বা মুহূর্ত সরকারের অভ্যন্তরে দ্রুত প্রসারিত হতে পারে। সম্ভবত এই ‘কার মোমেন্ট’-এর মাধ্যমে এমন কিছু গোপন আলোচনা হলো, যা কেবল এই দুই মিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল এবং যা ভবিষ্যতে দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্কের দিক নির্ধারণ করবে।
সব মিলিয়ে, পুতিনের এই সফর কেবল দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিশ্ব মঞ্চে ভারত ও রাশিয়ার কৌশলগত মিত্রতার এক নতুন অধ্যায় রচনা করল।



















