ব্যুরো নিউজ ৩০ মে : পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখন চরম উত্তেজনা। গতকাল, বৃহস্পতিবার (২৯শে মে, ২০২৫), আলিপুরদুয়ারে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা থেকে কার্যত ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরাসরি নিশানা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে, অভিযোগের আঙুল তুললেন দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে। তাঁর বক্তব্যের দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আক্রমণ করলেন মোদীজির ‘অপারেশন সিঁদুর’ মন্তব্য ও বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে। এর পরতে পরতে যুক্ত হয়েছে বিজেপি নেতাদের ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’-এর ডাক এবং তৃণমূলের কড়া প্রতিক্রিয়া।
মোদীর আক্রমণ: ‘নির্মম সরকার’ ও দুর্নীতির অভিযোগ
আলিপুরদুয়ারে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলার মাটিতে প্রথম জনসভায় এসেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্য সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেন। তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই উঠে আসে মুর্শিদাবাদ-মালদার সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রসঙ্গ। তৃণমূলের দিকে সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুলে মোদী বলেন:
- “মুর্শিদাবাদ-মালদহে যা হয়েছে, তা বর্তমান সরকারের নির্মমতার উদাহরণ। এখানকার সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রতি বার আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এভাবে কি কোনও সরকার চলতে পারে?”
তিনি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি প্রসঙ্গেও শাসকদলকে কাঠগড়ায় তোলেন:
- “তৃণমূলের নেতাদের দুর্নীতির জন্য এখানকার বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এঁরা নিজেদের ভুল মানতেই চাইছেন না। উল্টে আদালতকে আক্রমণ করছেন এঁরা। তৃণমূল সরকার অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বিজেপি এটা হতে দেবে না।”
কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হওয়ার অভিযোগেও তিনি রাজ্য সরকারকে বিঁধেন:
- “কেন্দ্রের অনেক বড় বড় জনসেবামূলক প্রকল্প এই রাজ্যে কার্যকর করা হয়না। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প এখানে চালু হতে দেওয়া হয়নি। এখানকার লোকেরা বাইরে গেলে ওই প্রকল্পের সুবিধা পান না। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতায় পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ বাড়ি পেতেন। কিন্তু এখানে তাও হতে দিল না এখানকার নির্মম সরকার।”বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
মমতার পাল্টা জবাব: ‘অপারেশন সিঁদুর’ রাজনীতি ও ব্যক্তিগত আক্রমণ
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দেড় ঘণ্টার মধ্যেই, ঠিক দুপুর সাড়ে ৩টে নাগাদ পাল্টা আক্রমণের ঝাঁজ নিয়ে মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ‘অপারেশন সিঁদুর’ প্রসঙ্গকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তীব্র ব্যক্তিগত আক্রমণ শানান:
- “ওই অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ ওঁরা দিয়েছেন। এই নাম দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। যে সময় বিজেপির সমর্থকেরাও দেশের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, সেই সময় নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসাবে এখানে রাজনীতির হোলি খেলতে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী!”
- “মহিলাদের অপমান করবেন না, নরেন্দ্র মোদী, তাদের সিঁদুর দিয়ে। নারীরা কেবল তাদের স্বামীদের কাছ থেকে সিঁদুর গ্রহণ করে। তারা কেন আপনার কাছ থেকে এটি গ্রহণ করবে? আপনি কেন প্রথমে আপনার নিজের মিসেসকে সিঁদুর দেননি?” (এই উক্তিটি নতুন সংযোজিত)
- “উনি আগে নিজেকে চা-ওয়ালা বলতেন। পরে বললেন, পাহারাদার! আর এখন সিঁদুর বেচতে এসেছেন?”
মোদীর জনসভা নিয়ে মমতা বলেন:
- “উনি বিভাজনের রাজনীতি করছেন। কেন আজ ওঁকে অসম থেকে লোক নিয়ে আসতে হল? তার মানে উত্তরবঙ্গের মানুষ ওঁকে চিনে গিয়েছেন। ওঁর উপর আর মানুষের বিশ্বাস নেই।”
প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবেও আক্রমণ করে মমতা বলেন:
- “এত বড় বড় কথা বলেন। সেনাকে স্যালুট করতে আসবেন ভেবেছিলাম। সিকিমে তো গেলেনই না। ভয় পান নাকি? বিদেশে তো এত ঘুরতেন। প্রচার হওয়া উচিত সেনার। এখনও জঙ্গিদের গ্রেফতার করতে পারেননি কেন? সব দেখানোর জন্য।”
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মমতা বলেন:
- “আগামিকালই নির্বাচন করুন।”
- “আপনাকে খোলা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। আজ বাংলা নিরাপদ বলে আপনি ঠিক নির্বাচনের আগে এখানে আসেন। আসেন বাংলার মানুষকে ভুল বোঝাতে, কুৎসা রটাতে, ষড়যন্ত্র করতে। মনিপুরে গেলেন না কেন? আপনার তো আগে ওখানে যাওয়া উচিত ছিল।”
- “আপনার রাজ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। আইন শৃঙ্খলা কেউ নিজের হাতে নিতে পারে না।”
‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’ মাদ্ধমে শুভেন্দু অধিকারীর চ্যালেঞ্জ মুখ্যমন্ত্রীকে
প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মুখে উঠে আসে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গের‘ কথা। তিনি বলেন, মোদীজির নেতৃত্বে বিজেপি নেতারা এই ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’ করবে এবং “তৃণমূলকে উৎখাত করে বঙ্গোপসাগরের জলে ফেলবে”। বিজেপির রাজ্য সভাপতির এই মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন:
- “তারা অপারেশন বেঙ্গল করার চেষ্টা করছে। আমি তাদের চ্যালেঞ্জ জানাই, আগামীকাল নির্বাচন ডাকুন, আমরা প্রস্তুত। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায়ও দেশের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন। আর প্রধানমন্ত্রী আমাদের সরকারের সমালোচনা করছেন। বিরোধীদের দোষারোপ করছেন। মোদী বাংলার মহিলাদের অসম্মান করেছেন। আমরা সকলকে সম্মান করি। কিন্তু নিজের আত্মসম্মানের বিনিময়ে নয়।”‘দক্ষিণায় পাক অধিকৃত কাশ্মির চাই’: সেনাপ্রধানকে জগদ্গুরু রামভদ্রাচার্য্যের স্পষ্ট বার্তা
মুখ্যমন্ত্রীর এই চ্যালেঞ্জের জবাবে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী পাল্টা মন্তব্য করেন:
- “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের সিঁদুর মুছতে ভালবাসেন। হরগোবিন্দ দাস, চন্দন দাসের স্ত্রীদের সিঁদুর তো উনিই মুছেছেন। ওনার মেহবুব আলম মুছেছেন। মোদীজির সঙ্গে লড়তে হবে না। আমি লড়েই হারিয়েছি। আবার ২০২৬ সালে হারাব।”
- “মোদীজি একটা গঙ্গা, মহা সমুদ্র। উনি কালীঘাটের নালা। কার সঙ্গে কার তুলনা করছেন। আমি হারিয়েছি, আগে আমার সঙ্গে লড়ুন, তারপর মোদীজি।”
- তিনি আরও দাবি করেন, “বাংলায় নির্বাচন রাষ্ট্রপতি শাসনে হবে। ২০০ সিটে হারবেন। উনি থার্ড হবেন। অন্যরা সেকেন্ড হবেন। পাঞ্জাবে কংগ্রেসের যা অবস্থা হয়েছে। এর অবস্থাও তাই হবে। পশ্চিমবঙ্গে ভোট হয় নাকি? আজকেও নরেন্দ্র মোদীর সভায় আসার সময় ২৫টা বাস ভেঙেছে। আমাদের রাজবংশী মানুষরা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি শাসনে ভোট করুন না।”
- শুভেন্দু অধিকারী মমতাকে “হিন্দু বিরোধী” এবং “মহিলা বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী” আখ্যা দিয়ে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে আক্রমণ করলেন তার উত্তর বাংলার মানুষ দিয়ে দেবে। ২৬ সালে বাংলার মানুষ প্রাক্তন করে দেবে। ভবানীপুরে হারাব।”
উপসংহার: আলিপুরদুয়ারের এই রাজনৈতিক মহাযুদ্ধ স্পষ্ট করে দিল যে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচন শুধু কেন্দ্রীয় ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেরও এক বড় মহড়া। দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বাস্তবায়ন, এবং রাজনৈতিক আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের এই চক্রে রাজ্যের রাজনীতি যে আরও উত্তপ্ত হতে চলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণ মানুষ এই বাগযুদ্ধের মাঝে নিজেদের ভাগ্য কোন দিকে গড়ায়, সেদিকেই তাকিয়ে আছে।