ব্যুরো নিউজ ১০ জুন : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতিকে কেন্দ্র করে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস শহর বর্তমানে তীব্র বিক্ষোভ ও অস্থিরতায় তপ্ত হয়ে উঠেছে। বেআইনি অভিবাসীদের গ্রেফতার ও বিতাড়নের বিরুদ্ধে হাজার হাজার অবৈধ বসবাসকারী রাস্তায় নেমেছে , যার জেরে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে, স্থানীয় প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
লস অ্যাঞ্জেলসে উত্তেজনা ও বিক্ষোভের সূত্রপাত
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বেআইনি অভিবাসীদের ব্যাপক হারে বিতাড়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল প্রতিদিন ৩ হাজার বেআইনি অভিবাসীকে গ্রেফতার করে বিতাড়িত করা এবং আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত বন্ধ করা। কর্মস্থল বা আদালত চত্বরের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় অভিযান চালানোর মতো কঠোর পদক্ষেপের কথাও তিনি আগেই জানিয়েছিলেন। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, ডেমোক্র্যাটিক প্রদেশ ক্যালিফোর্নিয়া বেআইনি অভিবাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ICE) সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার একটি কর্মস্থলে অভিযান চালিয়ে ৪৪ জন বেআইনি অভিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়। একই দিনে গ্রেটার লস অ্যাঞ্জেলসে আরও ৭৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই অভিযানকে ট্রাম্পের নতুন অভিবাসন নীতির অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরপরই লস অ্যাঞ্জেলস জুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈধ নথি না থাকা অভিযুক্ত অভিবাসীরা এই অভিযানের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
বিক্ষোভের তীব্রতা ও হিংসাত্মক রূপ
গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ফেডারেল ডিটেনশন সেন্টারের সামনে জড়ো হন এবং হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায় যখন পুলিশ তাদের বাধা দিতে শুরু করে। পুলিশের অভিযোগ, উন্মত্ত জনতা তাদের দিকে ইট ছুড়তে শুরু করে। বেশ কিছু গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন দোকানে অবাধে লুটপাট চালানো হয়। পাল্টা বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, বিনা প্ররোচনাতেই নিরস্ত্র জনতার উপর পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে।
রবিবার লস অ্যাঞ্জেলসে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। বিক্ষোভকারীরা একটি প্রধান মহাসড়ক অবরোধ করে এবং স্ব-চালিত গাড়িতে (self-driving cars) আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং ফ্ল্যাশ ব্যাং ব্যবহার করে। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ ‘বেআইনি সমাবেশ’ ঘোষণা করার পর অনেক বিক্ষোভকারী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, তবে কিছু অবশিষ্ট বিক্ষোভকারী পুলিশ এবং তাদের গাড়ির দিকে কংক্রিটের টুকরা, পাথর, ইলেকট্রিক স্কুটার এবং আতশবাজি ছুড়ে মারে।
সেনা মোতায়েন: ট্রাম্পের কঠোর পদক্ষেপ
পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রথমে লস অ্যাঞ্জেলস এলাকায় ২ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। রবিবার ট্রাম্প প্রশাসন আরও ২ হাজার ন্যাশনাল গার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে মোট ন্যাশনাল গার্ড সদস্যের সংখ্যা ৪ হাজারে দাঁড়ায়। সোমবার (১০ জুন, ২০২৫) ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স (Department of Defense) নিশ্চিত করেছে যে, ICE এবং ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সহায়তা করার জন্য অতিরিক্ত ২ হাজার ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হচ্ছে। এছাড়াও, প্রায় ৭০০ মেরিন সেনাকেও সেখানে মোতায়েন করা হচ্ছে।
এটি ১৯৯২ সালের লস অ্যাঞ্জেলস দাঙ্গার পর প্রথম ঘটনা, যেখানে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রাজ্যের গভর্নরের সম্মতি ছাড়াই ন্যাশনাল গার্ড সৈন্যদের ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে এনেছেন।
মাস্ক পরায় নিষেধাজ্ঞা ও গ্রেফতারের নির্দেশ
উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রবিবার ডোনাল্ড ট্রাম্প মাস্ক ব্যবহার করে বিক্ষোভে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তিনি তার ‘সোশ্যাল ট্রুথ’ (Social Truth) প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করে বলেন, “মাস্ক পরা লোকদের অবিলম্বে গ্রেফতার করুন।” যদিও ফেডারেল সরকারের এই ধরনের নির্দেশ কার্যকর করার আইনি ক্ষমতা আছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। বিক্ষোভকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে এবং পুলিশি অ্যাকশনের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া ও ধোঁয়াশা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে মাস্ক পরিধান করে আসছিলেন।
রাজনৈতিক সংঘাত ও আইনি জটিলতা
লস অ্যাঞ্জেলস ক্যালিফোর্নিয়ার একটি শহর, যেখানে ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির গভর্নর গ্যাভিন নিউসম ক্ষমতায় রয়েছেন। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে উস্কানিমূলক’ আখ্যা দিয়ে গভর্নর নিউসম সতর্ক করেছেন যে, এটি উত্তেজনা বাড়াবে এবং জনগণের আস্থা নষ্ট করবে। তিনি বলেছেন, “হিংসায় উস্কানি দেওয়া, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, বিরোধীদের গ্রেফতার করা কোনো প্রেসিডেন্টের কাজ নয়, স্বৈরাচারী শাসকের কাজ।”
ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য সরকার সোমবার ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করেছে, যেখানে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল রব বনটা ট্রাম্পের এই আদেশকে ফেডারেল ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দশম সংশোধনী ও ফেডারেল আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন, কারণ এটি গভর্নরের অনুমোদন ছাড়াই এবং স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করা হয়েছে। এর উত্তরে হোয়াইট হাউস বলেছে, গভর্নর নিউসমের উচিত ট্রাম্প প্রশাসনকে মামলা করার বদলে “এন্টি-আইসিই দাঙ্গাবাজদের” বিচার করার উপর মনোযোগ দেওয়া।
অভিন্ন চিত্র: ভারতের অভিজ্ঞতা ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে অভিবাসন নীতিকে কেন্দ্র করে যে ধরনের বিক্ষোভ ও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তার একটি অভিন্ন চিত্র ভারতেরও কিছু পরিস্থিতিতে পরিলক্ষিত হয়েছে। ভারতের মোদি সরকার যখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (CAA) পাশ করেছিল, তখন দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যে এই বিলের প্রতিবাদে ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। সাম্প্রতিক অতীতে, পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ আইন সংশোধনী সংক্রান্ত প্রতিবাদেও অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল, যেখানে বিক্ষোভ সহিংস রূপ ধারণ করে জনজীবনে প্রভাব ফেলেছিল।
উপসংহার
লস অ্যাঞ্জেলসের এই পরিস্থিতি ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অবৈধভাবে বসবাসকারীদের এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের এক চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেনার হস্তক্ষেপ, মাস্ক পরায় নিষেধাজ্ঞা এবং আইনি লড়াই—এই সব মিলিয়ে লস অ্যাঞ্জেলসের অস্থিরতা একটি জটিল সংকটের রূপ নিয়েছে, যার ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
এই ঘটনাগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে: বেআইনি অভিবাসীরা যেকোনো জাতির জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাড়াতে পারে। একটি প্রগতিশীল সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তির ফলে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি হতে পারে, যা প্রায়শই দাঙ্গা ও সহিংসতায় শেষ হয়। এই পরিস্থিতিতে, কঠোর অভিবাসন নীতি অপরিহার্য হয়ে দাড়ায়, যদিও আপাতদৃষ্টিতে তা কঠোর মনে হতে পারে। জাতীয় নিরাপত্তা এবং সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এই ধরনের পদক্ষেপগুলি প্রয়োজনীয়।