ব্যুরো নিউজ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : সনাতন ধর্মে বিশ্বকর্মা পূজা এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব, যা কারিগর, শিল্পী, প্রকৌশলী এবং যন্ত্রের সাথে জড়িত শ্রমিকদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। কেউ তাঁকে যন্ত্রের দেবতা রূপে পূজা করেন, আবার কেউ যন্ত্রকে চালিত করা শ্রমজীবী মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখেন। সৃষ্টির এই আদি প্রকৌশলী ও স্থপতির উদ্ভব এবং তাঁর মহিমা নিয়ে এই আলোচনা ।
বিশ্বকর্মার জন্মকথা
যখন এই মহাবিশ্ব নবসৃষ্ট হয়েছিল, ব্রহ্মা উপলব্ধি করেন যে কেবল সৃষ্টিই যথেষ্ট নয়। মহাবিশ্বকে প্রসারিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য এমন একজন সত্তার প্রয়োজন, যিনি নকশা, শৃঙ্খলা এবং কারিগরি দক্ষতার দ্বারা সবকিছুকে সুসংগঠিত করতে পারবেন।
ব্রহ্মা তাঁর দিব্য জ্যোতি থেকে এক স্বর্গীয় সত্তার জন্ম দেন। তাঁর চোখ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতো, তাঁর হাতে শোভা পেত শিল্পের সরঞ্জাম, এবং তাঁর অস্তিত্বে সৃষ্টির মূল নির্যাস মিশে ছিল। ইনিই হলেন ভগবান বিশ্বকর্মা—দেবতাদের দিব্য স্থপতি।
ঋগ্বেদে তাঁকে ‘পরম ব্রহ্মের’ রূপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে:
“তিনিই সূর্য ও পৃথিবীকে রূপ দিয়েছেন, আকাশ ও দিককে আকার দিয়েছেন।”
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে তাঁর উৎপত্তির ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়:
- কেউ কেউ বলেন, তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র।
- কেউ তাঁকে প্রজাপতি ত্বষ্টা ও ভাবনা দেবীর পুত্র হিসেবে বর্ণনা করেন।
- ভবিষ্য পুরাণ অনুসারে, তিনি দেবী ভুবনেশ্বরীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
তবে একটি বিষয়ে সকলে একমত: বিশ্বকর্মা ছাড়া স্বর্গ নির্মিত হতে পারত না, কিংবা মানব সভ্যতাও বিকশিত হতে পারত না।
সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ
সৃষ্টিতে বিশ্বকর্মার ভূমিকা
পৌরাণিক সূত্র অনুসারে, ব্রহ্মা বিশ্বকর্মাকে মহাবিশ্বকে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।
প্রাথমিকভাবে, সৃষ্টি একটি মহাজাগতিক ডিমের মতো ছিল। ব্রহ্মা এটিকে শেষনাগের উপর স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু সাপের প্রতিটি নড়াচড়ায় তা কেঁপে উঠত।
চিন্তিত হয়ে ব্রহ্মা বিশ্বকর্মার সাহায্য চাইলেন। তখন বিশ্বকর্মা সৃষ্টিকে স্থিতিশীল করার জন্য মেরু পর্বতকে জলের উপর স্থাপন করলেন। এই কাজটি তাঁর প্রকৌশলগত প্রতিভা প্রদর্শন করে, এবং সেই থেকে তিনি জগতের প্রথম প্রকৌশলী ও স্থপতি হিসেবে সম্মানিত হন।
বিশ্বকর্মার স্থাপত্যের অলৌকিক নিদর্শন
বিশ্বকর্মার সৃষ্টিগুলি কিংবদন্তী হয়ে আছে:
- সত্যযুগে – তিনি স্বর্গ নির্মাণ করেন।
- ত্রেতা যুগে – সুবর্ণ লঙ্কা।
- দ্বাপর যুগে – দ্বারকা নগরী।
- কলিযুগে – হস্তিনাপুর এবং ইন্দ্রপ্রস্থ।
অন্যান্য মহৎ কাজগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ইন্দ্রের জন্য ইন্দ্রপুরী।
- যমরাজের জন্য যমপুরী।
- বরুণের জন্য বরুণপুরী।
- কুবেরের জন্য কুবেরপুরী।
তিনি বহু ঐশ্বরিক অস্ত্রও তৈরি করেছিলেন:
- ভগবান শিবের ত্রিশূল।
- ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র।
- ভগবান ইন্দ্রের বজ্র।
এগুলি ছাড়া দেবতাদের পক্ষে অশুভ শক্তির উপর জয়লাভ করা অসম্ভব হতো। তিনি পুষ্পক বিমানও তৈরি করেছিলেন, যা ছিল দেবতা ও অসুরদের উড়ন্ত রথ। শহর থেকে প্রাসাদ, যন্ত্র থেকে অস্ত্র—বিশ্বকর্মার হাতেই সবকিছু আকার পেয়েছিল।
বিশ্বকর্মার রূপ ও বংশ
শাস্ত্র অনুসারে বিশ্বকর্মার পাঁচটি রূপ (অবতার) বর্ণিত আছে:
- বিরাট বিশ্বকর্মা
- ধর্মাবংশী বিশ্বকর্মা
- অঙ্গিরাবংশী বিশ্বকর্মা
- সুধন্বা বিশ্বকর্মা
- ভৃগু-বংশী বিশ্বকর্মা
তাঁকে প্রায়শই বিভিন্ন রূপে চিত্রিত করা হয়—কখনও দ্বিভুজ, চতুর্ভুজ বা দশভুজ, এবং এক থেকে পাঁচটি মুখও দেখা যায়। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন ঋষি মনু, যিনি ঋষি অঙ্গিরার কন্যা কাঞ্চনাকে বিবাহ করেন।
ভগবান বিশ্বকর্মার চিত্রকল্প
ঐতিহ্যগতভাবে, ভগবান বিশ্বকর্মাকে একটি সিংহাসনে উপবিষ্ট, হলুদ বস্ত্র ও গহনায় সজ্জিত অবস্থায় দেখানো হয়:
- তাঁর এক হাতে থাকে বিশ্বকর্মা পুরাণ।
- অন্য হাতে একটি বই।
- তৃতীয় হাতে নির্মাণের সরঞ্জাম, যা তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রতীক।
- চতুর্থ হাতে একটি কমণ্ডলু, যা সৃষ্টির প্রতীক।
বিশ্বকর্মা পূজা কেন উদযাপন করা হয়?
প্রতি বছর, কন্যা সংক্রান্তি (প্রায় ১৭-১৮ সেপ্টেম্বর), যখন সূর্য দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে, তখন আমরা বিশ্বকর্মা পুজো উদযাপন করি।
এই দিনে কারিগর, শ্রমিক, প্রকৌশলী, কৃষক এবং কারখানার কর্মীরা কেবল ভগবান বিশ্বকর্মাকে নয়, তাঁদের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামকেও পূজা করেন। একজন কাঠমিস্ত্রির করাত, কামারের হাতুড়ি, কৃষকের লাঙ্গল থেকে শুরু করে একজন প্রকৌশলীর কম্পিউটার পর্যন্ত—প্রত্যেকটি যন্ত্রকে সাজানো হয় এবং দিব্য রূপে পূজা করা হয়।
এই পূজার আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে:
- ঘর ও কর্মস্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা।
- বিশ্বকর্মার মূর্তি বা ছবি স্থাপন করা।
- গঙ্গা জল দিয়ে শুদ্ধিকরণ।
- প্রদীপ জ্বালানো, ফুল, চাল ও মিষ্টি নিবেদন করা।
- “বিশ্বকর্মণে নমঃ” মন্ত্র জপ করা।
- আরতি করা এবং প্রসাদ বিতরণ করা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রতিজ্ঞা—আগামী বছর সততা, ভক্তি এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করার প্রতিজ্ঞা।
Brahma ; সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সীমিত উপাসনা: এক বিস্ময়কর রহস্য !
গভীর বার্তা
বিশ্বকর্মা পূজা আমাদের শেখায় যে শ্রম নিজেই উপাসনা।
- যদি কৃষক লাঙ্গল না চালায়, তাহলে খাদ্য উৎপন্ন হবে না।
- যদি কাঠমিস্ত্রি কাঠকে আকার না দেয়, তাহলে ঘর তৈরি হবে না।
- যদি প্রকৌশলী যন্ত্র বা সেতুর নকশা না করে, তাহলে সমাজ অগ্রসর হবে না।
ছোট বা বড়—প্রত্যেকটি কাজই সৃষ্টির ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য। আর যখন তা আন্তরিকতার সাথে করা হয়, তখন তা ঈশ্বরের কাছে নিবেদন হয়ে ওঠে। এজন্যই একজন শ্রমিকের ঘামকে সবচেয়ে বিশুদ্ধ পবিত্র জল এবং তার সরঞ্জামকে সবচেয়ে সত্য উপাসনার বস্তু বলা হয়।
এমনকি আজকের প্রযুক্তির যুগেও, এই উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়: যন্ত্র এবং বিজ্ঞান তখনই সফল হয় যখন শ্রম এবং নিষ্ঠার সাথে যুক্ত হয়।
এটি আমাদের সরঞ্জামকে সম্মান করতে, আমাদের কাজকে সম্মান করতে এবং কেবল নিজেদের জীবন নয়, সমাজ ও জাতির প্রতিও অবদান রাখতে অনুপ্রাণিত করে। কারণ যখন মানুষ প্রেম ও সততার সাথে কাজ করে, তখন তারা নিজেরাই ঐশ্বরিকের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
উপসংহার
বিশ্বকর্মা পুজো কেবল একজন দেবতার আরাধনা নয়—এটি প্রতিটি কর্মঠ হাতের, প্রতিটি সৃষ্টিকারী যন্ত্রের, এবং প্রতিটি মনের উপাসনা, যা শ্রমে আনন্দ খুঁজে পায়। বিশ্বকর্মা পুজোর শাশ্বত বার্তা স্পষ্ট:
শ্রমই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, এবং সৃষ্টিই সর্বোচ্চ ধ্যান।