ব্যুরো নিউজ ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : “কালঃ কালায় নমঃ। অনাদিনিধনং দেবং কালকালনমচ্যূতং।”
সময়, এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে নির্মম এবং অপ্রতিরোধ্য শক্তি। এটি সবকিছুর জন্ম দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে, এবং অবশেষে মুছে দেয়। কিন্তু সনাতন ধর্ম আমাদের এমন একজনের কথা বলে, যিনি এই সময়ের নাগালের বাইরে। তিনি মহাকাল রূপে স্বয়ং ভগবান শিব। তিনি সময়ের দ্বারা আবদ্ধ নন, বরং সময় তাঁরই নির্দেশে চলে। অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎ তাঁর ভেতরেই বিদ্যমান, এবং সৃষ্টির শেষে সমস্ত সময় তাঁর অনন্ত চেতনায় ফিরে আসে।
এই কারণেই শিবকে মহাকাল, অর্থাৎ সময়ের অধিপতি রূপে পূজা করা হয়। তাঁর এই মহাজাগতিক ভূমিকা এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে তাঁর কয়েকটি মূল দিক আলোচনা করা প্রয়োজন।
১. শিব সময়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন
শিবকে শাস্ত্রে ‘কালাতীত’ বা সময়ের অতীত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা যে সময়কে জানি, তা মূলত এই সৃষ্টিজগতের পরিবর্তনের পরিমাপ। কিন্তু শিব হলেন সেই অপরিবর্তনীয় সত্য যা সৃষ্টির আগে ছিল, এর অস্তিত্বের সময়ে আছে এবং এর বিলুপ্তির পরেও থাকবে। তিনি সময়ের সঙ্গে চলেন না; বরং সময় তাঁর ভেতরেই গতিশীল। মহাকাল রূপে তাঁর পূজা করার অর্থই হলো এই সত্যকে স্বীকার করা যে, তিনি একমাত্র শাশ্বত, আর বাকি সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী।
সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ
২. সময়ের উৎস এবং প্রলয়ের কারণ
শিব ‘অনাদি’ (যার কোনো শুরু নেই) এবং ‘অনন্ত’ (যার কোনো শেষ নেই)। সৃষ্টির মহাচক্রে, যখন মহাবিশ্ব প্রকাশিত হয় তখন সময়ের শুরু হয় এবং যখন এটি বিলুপ্ত হয়, তখন সময়েরও অবসান ঘটে—আর এই সবকিছুই তাঁর ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়। লিঙ্গ পুরাণ অনুযায়ী, প্রতিটি কল্পের (মহাজাগতিক যুগ) শেষে স্বয়ং সময়ও শিবের মধ্যে মিশে যায়। তিনি কেবল সময়ের প্রবাহের অংশগ্রহণকারী নন, বরং এর উৎস এবং এর সমাপ্তিও। এ কারণেই তিনিই কাল-এর চূড়ান্ত অধিপতি।
৩. মহাকাল: মৃত্যু এবং ভয়ের বিনাশকারী
মানব জীবনের জন্য সময় ক্ষয়, বার্ধক্য এবং মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু মহাকাল হলেন তিনি, যিনি স্বয়ং মৃত্যুকেও গ্রাস করেন। আধ্যাত্মিক প্রতীকে, তিনি যম, অর্থাৎ মৃত্যুর দেবতার বিজয়ী। ভক্তরা কেবল মরণশীলতার ভয় থেকে মুক্তি পেতে নয়, বরং জন্ম ও পুনর্জন্মের চক্রকে অতিক্রম করতেও মহাকালের শরণাপন্ন হন। তাঁর উপস্থিতিতে সময়ের শক্তি ভয় দেখাতে পারে না, কারণ তিনি প্রকাশ করেন যে চেতনা মৃত্যুর ঊর্ধ্বে।
৪. কালের মহাজাগতিক নৃত্যশিল্পী
নটরাজ রূপটি, যেখানে শিবকে মহাজাগতিক নৃত্যশিল্পী হিসেবে দেখানো হয়, তা তাঁর সময়ের উপর নিয়ন্ত্রণকে প্রকাশ করে। তাঁর হাতে ধরা ডমরু সৃষ্টির ছন্দ তৈরি করে, আর আগুন ধ্বংসের প্রতীক। তাঁর নৃত্যের প্রতিটি চাল মহাবিশ্বের স্পন্দনকে প্রতিনিধিত্ব করে—জন্ম, প্রতিপালন এবং বিলুপ্তি। নটরাজ রূপে শিবের আরাধনার মাধ্যমে ভক্তরা তাঁকে শুধু একজন দূরবর্তী দেবতা হিসেবে দেখেন না, বরং অস্তিত্ব এবং সময়ের সেই পরম ছন্দ হিসেবে উপলব্ধি করেন।
৫. অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের শাশ্বত সাক্ষী
শিবকে ‘সাক্ষী চৈতন্য’ বা বিশুদ্ধ সাক্ষী হিসেবে বর্ণনা করা হয়। অন্যান্য প্রাণীর মতো তিনি অতীতের স্মৃতি বা ভবিষ্যতের উদ্বেগ দ্বারা আবদ্ধ নন। তিনি প্রভাবিত না হয়েই সময়কে পর্যবেক্ষণ করেন। একই সঙ্গে তিনি সময়ের তিনটি মাত্রাতেই সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত। তাঁর এই সাক্ষী-স্বরূপ গুণই তাঁকে সময়ের নিয়ন্তা করে তোলে, কারণ তিনি এর পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে থেকেও এর প্রবাহ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত।
৬. মহাকালেশ্বর: অমরত্বের পবিত্র স্থান
উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ শিবের অন্যতম আরাধিত মন্দির, যেখানে তাঁকে স্পষ্টভাবে ‘সময়ের অধিপতি’ হিসেবে পূজা করা হয়। উজ্জয়িনীকে দীর্ঘকাল ধরে সময় গণনা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি মহাজাগতিক কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হয়, যা মহাকালের সঙ্গে এর সংযোগকে আরও সুদৃঢ় করে। মন্দিরের বিখ্যাত ‘ভস্ম আরতি’, যেখানে শিবকে চিতার ছাই দিয়ে পূজা করা হয়, তা জীবনের ক্ষণস্থায়ীতা এবং মৃত্যু ও সময়ের উপর তাঁর প্রভুত্বের একটি গভীর স্মারক।
Brahma ; সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সীমিত উপাসনা: এক বিস্ময়কর রহস্য !
৭. মহাকালের মাধ্যমে মুক্তি লাভের পথ
অবশেষে, মহাকাল কোনো ভীতিপ্রদ বিনাশকারী নন, বরং তিনি একজন মুক্তিদাতা। তাঁর পূজা করার অর্থই হলো সময়-আবদ্ধ অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে নিজের শাশ্বত সত্তাকে উপলব্ধি করা। তাঁর উপর ধ্যান করার মাধ্যমে সাধক অতীত বা ভবিষ্যতের উদ্বেগ থেকে মুক্ত হন এবং বর্তমানের কালহীন সচেতনতায় প্রবেশ করেন। এই অবস্থায়, সময় আর কাউকে আবদ্ধ করতে পারে না, এবং আত্মা মোক্ষ বা জন্ম-মৃত্যুচক্র থেকে মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়।
কেন মহাকাল আজও গুরুত্বপূর্ণ?
শিবকে মহাকাল বলে ডাকার অর্থ এই গভীর সত্যকে স্বীকার করা: সময় কাউকে ছাড়ে না, তবুও শিবের কাছে স্বয়ং সময়ও মাথা নত করে। তিনি অস্তিত্বের চির ঘূর্ণমান চাকার কেন্দ্রে থাকা সেই শাশ্বত স্থিরতা। মহাকালের পূজা করার অর্থ সেই স্থিরতার কাছে আত্মসমর্পণ করা, ভয়কে জয় করে জীবনযাপন করা এবং আমাদের মরণশীল জীবনের ক্রমাগত সময় নির্বাহের ঊর্ধ্বে ওঠা।
শিবের মধ্যে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বিলীন হয়ে যায়, এবং যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো চিরন্তন।