ব্যুরো নিউজ ২৩ মে : আপনার কি কখনো এমন মনে হয়েছে যে আপনি নিজের মনের জালে আটকা পড়েছেন, যেখানে উদ্বেগ, ভয় এবং সন্দেহ আপনাকে ঘিরে ধরেছে যার যেন কোনো শেষ নেই? উদ্বেগ এমন একটি মানসিক যন্ত্রণা যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে। এটি মনের মধ্যে চলা এমন এক যুদ্ধ যা প্রায়শই জেতা অসম্ভব মনে হয়। কিন্তু কী হবে যদি এই সমস্যার উত্তর হাজার হাজার বছর আগে লেখা হয়ে থাকে, মনস্তত্ত্ব একটি বিজ্ঞান হওয়ার অনেক আগে? ইতিহাসের অন্যতম গভীর আধ্যাত্মিক গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এমন শাশ্বত জ্ঞান প্রদান করে যা আধুনিক গবেষণা এখন প্রমাণ করছে। শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা এবং সমসাময়িক মনস্তাত্ত্বিক কৌশলগুলিকে একত্রিত করে, আমরা উদ্বেগের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ খুঁজে পেতে পারি।
মনই যুদ্ধক্ষেত্র
উদ্বেগ একটি যুদ্ধ। কিন্তু শত্রু বাইরে নয়, এটি আমাদের ভেতরেই। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন:
“যে মনকে জয় করেছে, তার জন্য মনই শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আর যে মনকে জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে, তার জন্য মনই সবচেয়ে বড় শত্রু।” (গীতা ৬.৬)
এই শ্লোকটি একটি অপরিহার্য সত্য তুলে ধরে: মন হয় একটি শক্তিশালী মিত্র অথবা একটি ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হতে পারে। এটি নির্ভর করে আমরা কীভাবে মনকে প্রশিক্ষণ দিই তার ওপর। উদ্বেগ তখনই বেড়ে ওঠে যখন মনকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়, যা ভয়, অনুমান এবং সন্দেহের সঙ্গে বন্যভাবে ছুটতে থাকে। কিন্তু একজন যোদ্ধা যেমন তার দক্ষতা তীক্ষ্ণ করে, তেমনি আমরাও আমাদের মনকে আমাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং আমাদের জন্য কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে পারি।
অতিরিক্ত চিন্তার চক্র – কীভাবে ভাঙবেন এটি
অতিরিক্ত চিন্তা করা উৎপাদনশীল মনে হলেও, বাস্তবে এটি একটি মানসিক ফাঁদ। গবেষণা নিশ্চিত করে যে আমাদের বেশিরভাগ উদ্বেগই কখনো সত্যি হয় না। কর্নেল ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে আমাদের ৯১% ভয় ভিত্তিহীন। উপরন্তু, আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিদিন ৬,০০০-এরও বেশি চিন্তা প্রক্রিয়া করে, কিন্তু আমরা সেগুলোর একটি ক্ষুদ্র অংশকেই কাজে লাগাই। উদ্বেগ আমাদের এই বিশ্বাসে আটকে রাখে যে প্রতিটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমরা ব্যর্থতা বা বিপদ এড়াতে পারি। কিন্তু এটি একটি প্রতারণা।
শ্রীকৃষ্ণ এই দ্বিধার একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন:
“তোমার কর্মে অধিকার আছে, কিন্তু কর্মফলের উপর তোমার কোনো অধিকার নেই। ফলাফলের প্রতি আসক্ত হয়ো না।” (গীতা ২.৪৭)
এই শিক্ষা কগনিটিভ ডিফিউশন (Cognitive Defusion) নামক একটি মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা আমাদের কষ্টকর চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে সাহায্য করে। “আমি উদ্বিগ্ন” বলার পরিবর্তে, বলুন “আমি লক্ষ্য করছি যে উদ্বেগ এখানে উপস্থিত।” এই সাধারণ পরিবর্তন উদ্বেগের সাথে আমাদের সম্পর্ককে বদলে দেয়। একইভাবে, “যদি আমি ব্যর্থ হই?” এমন চিন্তা করার পরিবর্তে, “যদি ব্যর্থতা আসে তবে আমি তা সামলে নেব।” এভাবে চিন্তাগুলিকে আদেশ না করে পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে আমরা উদ্বেগের বাঁধন আলগা করি।
ভারতের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ ও রাশিচক্রের সম্পর্ক
ভয়ের বিজ্ঞান – এবং কীভাবে এটিকে বিলীন করবেন
ভয় বাস্তবতা থেকে আসে না; এটি বাস্তবতার প্রতি আমাদের উপলব্ধি থেকে আসে। নিউরোসায়েন্স দেখিয়েছে যে আমাদের মস্তিষ্কের অ্যালার্ম সিস্টেম অ্যামিগডালা (amygdala) বাস্তব এবং কাল্পনিক হুমকির মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। এর অর্থ হলো, আমাদের ভয়কে এড়িয়ে চললে তা কেবল শক্তিশালী হয়। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল নিশ্চিত করে যে আমরা যত বেশি ভয় এড়াই, ততই এটি আমাদের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।
শ্রীকৃষ্ণ একটি শক্তিশালী প্রতিষেধক দিয়েছেন:
“ভয়প্রাপ্তদের জন্য এই জগৎ বা পরজগৎ কোনটিই নেই।” (গীতা ২.৪০)
এটি এক্সপোজার থেরাপি (Exposure Therapy)-র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা উদ্বেগ কমানোর একটি প্রমাণিত মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি। ছোট, নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপে আমাদের ভয়ের মুখোমুখি হওয়া মস্তিষ্ককে পুনর্গঠিত করে সেগুলিকে কম হুমকি হিসেবে দেখতে সাহায্য করে। আপনার সবচেয়ে বড় ভয়টি লিখে শুরু করুন। তারপর, সেটির মুখোমুখি হওয়ার জন্য ক্ষুদ্রতম পদক্ষেপটি নিন। আপনি ধীরে ধীরে এক্সপোজার বাড়ানোর সাথে সাথে ভয় আপনার উপর তার শক্তি হারাবে। মনে রাখবেন: আপনি যখন ভয়ের দিকে এগিয়ে যান, ভয় তখন সংকুচিত হয়।
কেন উদ্বেগ অন্তহীন মনে হয় – স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষমতা দখল
আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে আপনি চাপের একটি চক্রে আটকা পড়েছেন, এমনকি যখন আসলে কোনো সমস্যা নেই? দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ স্নায়ুতন্ত্রকে যুদ্ধ-বা-পালানোর (fight-or-flight) মোডে আটকে রাখে। শরীর বাস্তব বিপদ এবং কাল্পনিক বিপদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, যার ফলে ক্রমাগত উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
শ্রীকৃষ্ণ শিক্ষা দেন: “সমতায় অবিচল থাকো। সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রতি আসক্তি থেকে মুক্ত হও।” (গীতা ২.৪৮)
স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করার জন্য, আমরা নার্ভাস সিস্টেম রেগুলেশন টেকনিক (Nervous System Regulation Techniques) ব্যবহার করতে পারি:
- ৪-৭-৮ শ্বাসপ্রশ্বাস (4-7-8 Breathing): ৪ সেকেন্ডের জন্য শ্বাস নিন, ৭ সেকেন্ডের জন্য ধরে রাখুন, ৮ সেকেন্ডের জন্য শ্বাস ছাড়ুন। এই পদ্ধতি হৃদস্পন্দন কমায় এবং উদ্বেগ হ্রাস করে।
- প্রগতিশীল পেশী শিথিলকরণ (Progressive Muscle Relaxation): প্রতিটি পেশী গ্রুপকে টানটান করুন, তারপর শিথিল করুন। এটি মস্তিষ্ককে যুদ্ধ-বা-পালানো থেকে শিথিলকরণে স্থানান্তরিত হওয়ার সংকেত দেয়।
- ঠান্ডা জলের এক্সপোজার (Cold Exposure): মুখে ঠান্ডা জল ছিটানো ভেগাস নার্ভকে সক্রিয় করে, যা উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
তুলনার ফাঁদ – এবং কীভাবে এটি থেকে বেরিয়ে আসবেন
সোশ্যাল মিডিয়া বাস্তবতাকে বিকৃত করে, কেবল হাইলাইট রিল দেখায় যখন সংগ্রামগুলি লুকিয়ে রাখে। এটি তুলনার ফাঁদকে বাড়িয়ে তোলে, যা আমাদের নিজেদেরকে অপর্যাপ্ত মনে করায়। NIH (National Institutes of Health)-এর গবেষণা প্রকাশ করে যে অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার উদ্বেগ এবং হতাশা ৭০% বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু, UCLA-এর গবেষণা দেখায় যে মস্তিষ্ক সামাজিক প্রত্যাখ্যানকে শারীরিক ব্যথার মতো প্রক্রিয়া করে।
শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ দেন:
“যে ব্যক্তি প্রশংসা বা সমালোচনা দ্বারা বিরক্ত হন না, তিনিই প্রকৃত শান্ত।” (গীতা ১২.১৯)
তুলনা থেকে মুক্ত হতে, ডিজিটাল ডিটক্স এবং ডোপামিন রিসেট (Digital Detox & Dopamine Reset) চেষ্টা করুন:
- যে অ্যাকাউন্টগুলি নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে সেগুলিকে আনফলো (Unfollow) করুন।
- নিষ্ক্রিয় স্ক্রোলিং-এর পরিবর্তে অর্থপূর্ণ সংযোগ স্থাপন করুন।
- প্রতিদিন আপনার নিজের যাত্রা সম্পর্কে তিনটি জিনিস লিখুন যা আপনি ভালোবাসেন।
মনে রাখবেন, আপনার পথ শুধুমাত্র আপনার। কোনো তুলনা প্রয়োজন নেই।
উদ্বেগের মূল – নিয়ন্ত্রণ বনাম আত্মসমর্পণ
মূলত, উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণের অযোগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত হয়। মস্তিষ্ক নিশ্চিততা চায়, কিন্তু জীবন অপ্রত্যাশিত। আমরা যত শক্ত করে আঁকড়ে ধরি, ততই আমরা নিষ্কাশিত হই। আপনি প্রথমে কোন কৌশলটি চেষ্টা করবেন? মনকে আয়ত্ত করার আপনার যাত্রা এখন শুরু হচ্ছে।
শ্রীকৃষ্ণ আমাদের মনে করিয়ে দেন: “অপ্রয়োজনে কেন চিন্তা করো? কাকে ভয় পাও? কে তোমাকে হত্যা করতে পারে? আত্মা জন্মেও না মরেও না।” (গীতা ২.২৩)
এই জ্ঞান র্যাডিক্যাল অ্যাকসেপট্যান্স (Radical Acceptance)-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা একটি মনস্তাত্ত্বিক অনুশীলন যা আমাদের শেখায় যা আমরা পরিবর্তন করতে পারি না তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে। উচ্চস্বরে বলুন: “আমি যা আছে তা গ্রহণ করি। যা হবে তাতে আমি বিশ্বাস করি।” শুধুমাত্র যা আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন—আপনার প্রচেষ্টা, আপনার মানসিকতা, আপনার প্রতিক্রিয়া—তার উপর মনোযোগ দিন। শান্তি নিয়ন্ত্রণে পাওয়া যায় না; এটি আত্মসমর্পণে পাওয়া যায়।
বেদে মাংস ভক্ষণের সমর্থন নেই – প্রমাণসহ তথ্য !
শান্তির আসল রহস্য
অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, “আমার উদ্বেগ কখন চলে যাবে?” সত্য হলো, এটি সম্পূর্ণভাবে চলে যাবে না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এটি আপনার জীবন শাসন করবে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন:
“আসক্তি ছাড়াই তোমার কর্তব্য পালন করো। স্থির মন শান্তি আনে।” (গীতা ৫.১২)
এই শিক্ষা উদ্দেশ্য-চালিত কর্ম (Purpose-Driven Action)-এর প্রতিচ্ছবি—ভয় থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে যাওয়া। যখন আমরা অর্থপূর্ণ কাজে গভীরভাবে নিযুক্ত থাকি তখন উদ্বেগ তার শক্তি হারায়। ভয়ের কমার জন্য অপেক্ষা করবেন না; যাই হোক না কেন কাজ করুন। আজ এমন একটি কাজ করুন যা আপনার মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এমনকি উদ্বেগ উপস্থিত থাকলেও।
আপনার উদ্বেগ আপনার পরিচয় নয়
আপনি আপনার চিন্তা নন। আপনি আপনার ভয় নন। আপনি আপনার সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি নন। আপনি দর্শক, কোলাহলের বাইরে সচেতনতা।
শ্রীকৃষ্ণ আশ্বাস দেন: “আত্মা চিরন্তন, ভয় দ্বারা অটল, জন্ম ও মৃত্যুর অতীত।” (গীতা ২.২০)
উদ্বেগ কেবল একজন দর্শক। আপনি স্থায়ী।
চূড়ান্ত সত্য
আপনার মন শক্তিশালী। এটি দুঃখ সৃষ্টি করতে পারে—অথবা স্বাধীনতা। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং আধুনিক মনোবিজ্ঞান একমত:
- মন একটি হাতিয়ার—এটি প্রশিক্ষণ দিন, একে আপনাকে প্রশিক্ষণ দিতে দেবেন না।
- ভয়ের মুখোমুখি হলে তা শক্তি হারায়।
- শান্তি আসে আত্মসমর্পণ থেকে, নিয়ন্ত্রণ থেকে নয়।