ব্যুরো নিউজ ৯ জুন : পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ-ভিত্তিক কট্টরপন্থী গোষ্ঠী জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত ৭টি জেলায় তাদের মডিউল স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর। এই তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এই চাঞ্চল্যকর খবর এমন এক সময়ে সামনে এল, যখন দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সুরক্ষা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের টানাপোড়েন চলছিল। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো অভিযানের পর রাজ্য সরকার যেন তড়িঘড়ি মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন অনেকে।

জেএমবি’র মডিউল তৈরির ছক ও গ্রেফতার:

গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, জেএমবি’র দুই-পর্যায়ের মডিউল তৈরির পরিকল্পনার তথ্য মূলত সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া তিন জেএমবি সহযোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া গেছে। গত মাসে বীরভূম থেকে আজমল হোসেন এবং সাহেব আলী খান নামে দু’জনকে এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে আব্বাসউদ্দিন মোল্লা নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীদের মাঠ পর্যায়ের তথ্যের মাধ্যমেও এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
সূত্র আরও যোগ করেছে যে, প্রথম ধাপে বাংলাদেশি কট্টরপন্থী গোষ্ঠী মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর দিনাজপুর এই তিনটি জেলাকে মডিউল তৈরির জন্য লক্ষ্য করেছে। এই তিনটি জেলায় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর, তাদের পরবর্তী চারটি লক্ষ্য হবে উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া এবং বীরভূম জেলা।

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে

রাজ্যের সংবেদনশীল এলাকাগুলি নিশানায়:

রাজ্য পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, এই পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে সংবেদনশীল এলাকাগুলি এর আওতায় আসে। উত্তর দিনাজপুর এবং মালদা জেলা রাজ্যের উত্তর অংশে অবস্থিত হলেও, বাকি পাঁচটি জেলা দক্ষিণ অংশে রয়েছে। বীরভূম বাদে বাকি ছয়টি জেলারই বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। বীরভূম যদিও আন্তর্জাতিক সীমান্তবিহীন জেলা, তবে এটি মুর্শিদাবাদের মাধ্যমে দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ পথ হিসেবে কাজ করে। উল্লেখ্য, কোটি টাকার গরু পাচার মামলায় সিবিআই তদন্তে প্রকাশ পেয়েছিল যে, সেই কেলেঙ্কারিতে বীরভূম মুর্শিদাবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাচারের প্রধান ট্রানজিট রুট হিসেবে কাজ করেছিল।

মডিউল তৈরির পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক যোগসূত্র:

এই মডিউল তৈরির পদ্ধতি ছিল প্রথমে যুবক, এমনকি নাবালকদেরও মগজধোলাই করা এবং পরবর্তীতে তাদের স্লিপার সেলে অন্তর্ভুক্ত করা। গ্রেফতারকৃত তিন জেএমবি কর্মীর দ্বারা লক্ষ্যবস্তু হওয়া কিছু যুবকের সম্পর্কে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা জেএমবি’র তিনজন ভারতীয় সহযোগীর মধ্যে অন্যতম আব্বাসউদ্দিন মোল্লার পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন, যাকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (STF) এই মাসের শুরুতে গ্রেফতার করেছিল।
তদন্তকারীদের অনুসন্ধান অনুযায়ী, আজমল হোসেন এবং সাহেব আলী খানের মোবাইল ফোন থেকে উদ্ধার হওয়া গোপন এনক্রিপ্ট করা বার্তাগুলি থেকে বাংলাদেশ-ভিত্তিক কট্টরপন্থী সংগঠন যেমন জেএমবি, হিযবুত তাহরীর (HUT), এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (ABT)-এর সহযোগীদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র দেখা গেছে। তবে, মোল্লার মোবাইল ফোন থেকে উদ্ধার হওয়া একই ধরনের গোপন এবং এনক্রিপ্ট করা বার্তাগুলি পাকিস্তান-ভিত্তিক কিছু ব্যক্তি এবং জম্মু ও কাশ্মীর-ভিত্তিক কট্টরপন্থী গোষ্ঠী আনসার গাজওয়াত-উল-হিন্দ-এর কিছু সহযোগীর সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগের প্রমাণ দেয়।

সীমান্ত সুরক্ষায় রাজ্য সরকারের দীর্ঘদিনের অবহেলা ও তড়িঘড়ি পদক্ষেপ:

বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান সীমান্ত সংকটের মধ্যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশেষে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (BSF)-কে ৩৫৬ একর জমি দ্রুত হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর ফলে যেসব এলাকায় এখনও কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়নি, সেসব এলাকায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী অবিলম্বে বেড়া বসানোর কাজ শুরু করতে পারবে। রাজ্য সরকারের একজন বরিষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নব্বান্ন থেকে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির জেলাশাসকদের, যাদের বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, ইতিমধ্যেই নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। যে জেলাগুলিতে প্রশাসনিক প্রধানদের এই নির্দেশ পাঠানো হয়েছে সেগুলির মধ্যে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার ও মালদা এবং দক্ষিণবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও নদিয়া অন্তর্ভুক্ত।
রাজ্য সরকারের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, “গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রাজ্য সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকের পর, রাজ্য সরকার যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে জমি হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে।”

আলিপুরদুয়ারের জনসভায় মোদীর বার্তা : ‘নির্মম সরকার’কে উপড়ে ফেলে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’র ডাক!

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় সরকার বিএসএফ-এর কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ এবং অরক্ষিত সীমান্ত পয়েন্টগুলিতে পোস্ট স্থাপনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলার সীমান্ত এলাকায় মোট ৬৮০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ইতিমধ্যেই অর্থ প্রদান করেছে।
গত কয়েক বছর ধরে অরক্ষিত সীমান্ত পয়েন্টগুলি বিএসএফ-এর জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এই সময়ে এই অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে, যেখানে বাংলাদেশ-ভিত্তিক কট্টরপন্থী গোষ্ঠী যেমন জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হিযবুত তাহরীর (HUT), এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (ABT) রাজ্যের বিভিন্ন সীমান্ত জেলায় স্লিপার সেল স্থাপনের জন্য এই অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে তাদের কর্মীদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। এই তড়িঘড়ি পদক্ষেপ, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো সফল অভিযানের পর রাজ্য সরকারের উপর তৈরি হওয়া চাপের ফলশ্রুতি বলে অনেকে মনে করছেন, যেখানে সীমান্ত সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিনের অবহেলা প্রকট হয়ে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর