ব্যুরো নিউজ ১০ জুন : জম্মু ও কাশ্মীর-এর পাহেলগামে গত ২২ এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি (Indus Waters Treaty – IWT) স্থগিত করে দিয়েছে। এই হামলার ফলে ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন। ভারতের এই পদক্ষেপের কারণে পাকিস্তানে, বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশে, তীব্র জলসংকট দেখা দিয়েছে, যা দেশটির কৃষি খাতকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। পাকিস্তানের সিন্ধু নদী সিস্টেম অথরিটি (IRSA)-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছর সিন্ধু অববাহিকা থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ ১৩.৩% কমে গেছে।
জল ছাড়ের পরিমাণ ও খরিফ ফসলে প্রভাব
পাকিস্তান বর্তমানে একটি কঠিন খরিফ (গ্রীষ্মকালীন ফসল) বপন মরসুমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। দেশটির দুটি প্রধান বাঁধ—ঝিলাম নদীর উপর অবস্থিত মংলা (Mangla) এবং সিন্ধু নদীর উপর অবস্থিত তারবেলা (Tarbela)—উভয়েরই ‘লাইভ স্টোরেজ’ (live storage) বা কার্যকর জল মজুতের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এর পাশাপাশি, পাহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের দ্বারা জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে চেনাব নদীতে জলের প্রবাহ হঠাৎ কমে গেছে।
IRSA-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ৫ জুন বাঁধগুলিতে ১,২৪,৫০০ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে, যেখানে গত বছর একই সময়ে ১,৪৪,০০০ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছিল। এই বিশাল ঘাটতি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের কৃষকদের জন্য এক গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। IRSA তার বিবৃতিতে “উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছে” যে, “মারালার কাছে চেনাব নদীতে জলের প্রবাহে ভারতের কম সরবরাহের কারণে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় খরিফ মরসুমের শুরুতে আরও ঘাটতি দেখা দেবে”। তারা ২১% সামগ্রিক ঘাটতি ঘোষণা করেছে এবং বাঁধ কর্তৃপক্ষ ও সেচ সরবরাহ পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলিকে “চেনাব নদীতে ভারতীয় কম সরবরাহের কারণে সৃষ্ট সংকট” বিবেচনা করে বিচক্ষণতার সাথে জলাধার থেকে জল ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে।
এই জলসংকট খরিফ শস্যের বপনকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, কারণ এই ফসলগুলি গ্রীষ্মের শুরুতে জলের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল। কৃষি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, দ্রুত বর্ষার আগমন না ঘটলে বিশাল এলাকা অনাবাদি থেকে যেতে পারে। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, কেবল খরিফ মরসুমের শুরুতেই ২১% জলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সিন্ধু, বালুচিস্তান এবং করাচির মতো অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে, যেখানে তাপমাত্রা ৩৭°C বা তার বেশি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ গত সপ্তাহে তাজিকিস্তানের দুশানবেতে হিমবাহ সংরক্ষণ সংক্রান্ত এক সম্মেলনে ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ প্রকাশের কারণ সম্ভবত এই তীব্র জলসংকট।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
ভারতের কৌশলগত পরিবর্তন ও পরিকাঠামো উন্নয়ন
পাকিস্তান চুক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য আবেদন জানালেও ভারত নীরবতা পালন করছে। এর পরিবর্তে ভারত তার জল পরিকাঠামো উন্নয়নের গতি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রক উচ্চাভিলাষী চেনাব-রাভি-বিয়াস-সতলজ সংযোগ খাল প্রকল্পের জন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করেছে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য হল ১৫-২০ মিলিয়ন একর-ফুট জল ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলিতে প্রবাহিত করা, যাতে ক্রমবর্ধমান কৃষি ও শিল্প চাহিদা মেটানো যায়।
যদিও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে বর্তমানে ভারত সরাসরি সিন্ধু নদ থেকে জল সরিয়ে নিতে পারছে না, তবে কর্মকর্তারা জাস্কার এবং পীর পাঞ্জাল পর্বতমালা জুড়ে উন্নত সুড়ঙ্গ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবিষ্যতের প্রকল্পের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। চেনাব নদীর উপর ভারতের নিজস্ব জলাধার – বাগলিয়ার (Baglihar) এবং সালাল (Salal) – থেকে ভারত আপাতত শুধু পলি পরিষ্কার করে অতিরিক্ত জল মজুতের ব্যবস্থা করেছে।
জাতীয় নিরাপত্তাকে চুক্তির স্থগিতাদেশের ভিত্তি
ভারত ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থগিত করেছে, এর কারণ হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ উল্লেখ করা হয়েছে। নিরাপত্তা বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি (Cabinet Committee on Security) এই পদক্ষেপকে অনুমোদন দিয়েছে, যা এই চুক্তির ইতিহাসে প্রথমবার এমন স্থগিতাদেশ। ভারতীয় কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন যে, পাকিস্তান যতক্ষণ না আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং স্থায়ী বন্ধ প্রদর্শন করবে, ততক্ষণ চুক্তিটি স্থগিত থাকবে।
পাকিস্তানের আবেদন অনত্তর ও জল উপাত্ত বন্ধ
পাকিস্তান চারটি কূটনৈতিক চিঠি পাঠিয়েছে এবং বিশ্বব্যাংকের হস্তক্ষেপের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে, কিন্তু কোনো ইতিবাচক সাড়া পায়নি। বিশ্বব্যাংক মধ্যস্থতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, ভারত তার অবস্থানে অনড় রয়েছে, এবং ইসলামাবাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত ভবিষ্যতে কোনো সহযোগিতার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণভাবে, ভারত গত মাসে পাহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পর চুক্তি স্থগিত করার পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথে জলের প্রবাহের উপাত্ত (water flow data) ভাগ করে নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। কর্মকর্তাদের ধারণা, যেহেতু ভারত IWT স্থগিত করার পর পাকিস্তানের সাথে জলের উপাত্ত ভাগ করতে বাধ্য নয়, তাই বর্ষা মৌসুমে যখন সিন্ধু নদী ব্যবস্থার ক্যাচমেন্ট এলাকার বড় অংশ ভারতের মধ্যে পড়ে, তখন সর্বোচ্চ প্রবাহের সময় পাকিস্তানকে বন্যা মোকাবেলা করা কঠিন হবে।
পাকিস্তানের কৃষিক্ষেত্রে পশ্চিমী নদীগুলির নির্ভরতা
পাকিস্তানের দুটি প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং সিন্ধের কৃষি কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে সিন্ধু নদী ব্যবস্থার সেচ খালের উপর নির্ভরশীল, যা তার প্রায় সমস্ত জল পশ্চিমের নদীগুলি — সিন্ধু, ঝিলাম এবং চেনাব থেকে পায়। IWT অনুসারে ভারত পূর্বের নদীগুলির (রাভি, সুতলজ এবং বিয়াস) জলের উপর পূর্ণ অধিকার রাখলেও, ভারতীয় পক্ষে জল ব্যবহারের অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর কারণে পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবে তার বাধ্যবাধকতার চেয়ে বেশি জল পেয়েছে।
ভারতের অব্যবহৃত মজুত অধিকার
ভারতের পশ্চিমা নদীগুলিতে ৩.৬ মিলিয়ন একর ফুট (MAF) পর্যন্ত জল মজুত করার অনুমতি থাকা সত্ত্বেও, ভারত এই অধিকার সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করেনি। এর ফলে, পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবে চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্ত জলের চেয়ে বেশি জল পেয়েছে, যা এখন পরিবর্তিত কূটনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের সাথে পরিবর্তন হতে পারে।
উপসংহার এই অচলাবস্থা পাকিস্তানের জন্য একটি গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভারতের জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত এবং এর ফলে পাকিস্তানের কৃষি ও জল ব্যবস্থাপনার উপর গুরুতর প্রভাব, আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন জটিলতা তৈরি করেছে।