ব্যুরো নিউজ ১৯ জুন : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর তিন-জাতি সফরের শেষ ধাপে বুধবার ক্রোয়েশিয়ার জাগরেবে পৌঁছেছেন। এটি কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্রোয়েশিয়ায় প্রথম সফর, যা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ক্রোয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ প্লেনকোভিচের আমন্ত্রণে এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও গভীর করার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর নতুন সুযোগ তৈরি করবে। উল্লেখ্য, ক্রোয়েশিয়া বিশ্ব ফুটবলে তাদের অসামান্য সাফল্যের জন্য সুপরিচিত, যেখানে তারা ফিফা বিশ্বকাপে তাদের দক্ষতা বারবার প্রমাণ করেছে।
উষ্ণ অভ্যর্থনা ও অভিন্ন মূল্যবোধের বার্তা
জাগরেবে পৌঁছানোর পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ভারতীয় প্রবাসীরা উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। ‘বন্দে মাতরম’ এবং ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানানো হয় এবং ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পোশাকে নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এই অভ্যর্থনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ক্রোয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
জাগরেবে ক্রোয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ প্লেনকোভিচের সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বহুত্ববাদ এবং সমতা – এইগুলি দুটি দেশকে একত্রিত করে এমন অভিন্ন মূল্যবোধ। তিনি আরও বলেন যে, সন্ত্রাসবাদ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শক্তির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, “আমি ক্রোয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে জাগরেবে আমাকে এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এটি কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্রোয়েশিয়ায় প্রথম সফর, এবং আমি এই সুযোগ পেয়ে সম্মানিত।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, গত বছর ভারত ও ক্রোয়েশিয়ার জনগণ উভয় প্রধানমন্ত্রীকে টানা তৃতীয়বারের মতো দেশ সেবার সুযোগ দিয়েছে, যা একটি আনন্দদায়ক কাকতালীয় ঘটনা।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব
প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন যে, উভয় দেশই তাদের তৃতীয় মেয়াদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তিন গুণ দ্রুত বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি জানান, “প্রতিরক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতার জন্য একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা পরিকল্পনা তৈরি করা হবে, যা প্রশিক্ষণ এবং সামরিক বিনিময়ের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা শিল্পের উপরও মনোযোগ দেবে।”
প্রধানমন্ত্রী মোদি উল্লেখ করেন যে, উভয় দেশের অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে এমন অনেক ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে এবং একটি নির্ভরযোগ্য সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে উভয় দেশ অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা ফার্মা, কৃষি, তথ্য প্রযুক্তি, ক্লিন প্রযুক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য শক্তি সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াবো।”
বন্দর আধুনিকীকরণ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়
প্রধানমন্ত্রী মোদি জানান যে, ভারতের সাগরমালা প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত বন্দর আধুনিকীকরণ, উপকূলীয় অঞ্চল উন্নয়ন এবং বহু-মোডাল সংযোগে ক্রোয়েশিয়ান কোম্পানিগুলির জন্য প্রচুর সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং কেন্দ্রগুলির মধ্যে যৌথ গবেষণা ও সহযোগিতার উপর জোর দিয়েছি। ভারত ক্রোয়েশিয়ার সাথে তার মহাকাশ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবে।” শতাব্দীর প্রাচীন সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পারস্পরিক স্নেহ এবং শুভেচ্ছার মূল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আজ, আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক এবং জনগণ-থেকে-জনগণ সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জাগরেব বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি চেয়ারের সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি প্রস্তুত করা হয়েছে। মানুষের চলাচল সহজ করার জন্য দ্রুত গতিশীলতা চুক্তি সম্পন্ন হবে।”
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও কূটনৈতিক তাৎপর্য
প্রধানমন্ত্রী প্লেনকোভিচ উল্লেখ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক মুহূর্তে এসেছে। তিনি বলেন, “আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জাগরেবে স্বাগত জানিয়েছি! বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এটি প্রথম সফর, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক মুহূর্তে এসেছে।” প্লেনকোভিচ আরও বলেন যে, উভয় দেশ তাদের সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করছে এবং একাধিক ক্ষেত্র ও বিভাগে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য পরিস্থিতি তৈরি করছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক্সে (পূর্বে টুইটার) পোস্ট করেছেন, “ভারত-ক্রোয়েশিয়া সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক চিহ্নিত করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্রোয়েশিয়ার জাগরেবে অবতরণ করেছেন। এটি কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্রোয়েশিয়ায় প্রথম সফর। একটি বিশেষ অঙ্গভঙ্গি হিসাবে, প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ প্লেনকোভিচ বিমানবন্দরের প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক স্বাগত জানিয়েছেন।”
প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্রোয়েশিয়ায় আসার আগে কানাডায় জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন বিশ্বনেতার সাথে আলোচনা করেছিলেন। এর আগে তিনি তার সফরের অংশ হিসেবে সাইপ্রাসও পরিদর্শন করেছেন। এই সফরে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রধানমন্ত্রী প্লেনকোভিচের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করবেন এবং প্রেসিডেন্ট জোরান মিলানোভিচের সাথে দেখা করবেন।
উপসংহার প্রধানমন্ত্রী মোদির এই ঐতিহাসিক ক্রোয়েশিয়া সফর ভারত ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অভিন্ন মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে এই সহযোগিতা দুই দেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।