ব্যুরো নিউজ, ০৫ই ডিসেম্বর ২০২৫ : মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীরকে দল থেকে সাসপেন্ড করার ঘটনা রাজ্যের রাজনীতিতে এক গভীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ৬ ডিসেম্বর বেলডাঙায় বাবরি মসজিদের ধাঁচে নতুন একটি কাঠামো তৈরির বিতর্কিত ঘোষণাটি প্রকাশ্যে পুনরাবৃত্তি করার পরই দ্রুত এই পদক্ষেপ নিল শাসকদল। কলকাতা পুরসভার মেয়র তথা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম স্পষ্ট জানিয়েছেন, “ধর্মীয় নির্মাণের অজুহাতে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার কোনো চেষ্টা দল মেনে নিতে পারে না।”
সাসপেনশন: কারণ নাকি অজুহাত?
হুমায়ুন কবীর অবশ্য সাসপেনশনকে তোয়াক্কা না করে পাল্টা আক্রমণ শানিয়েছেন। সাসপেনশনের খবর পাওয়ার পরই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সভার স্থান ত্যাগ করেন এবং জানিয়ে দেন যে তিনি বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করবেন এবং ২২ ডিসেম্বর নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবেন। তাঁর অভিযোগ, রাজ্যে সরকারি টাকায় মন্দির বানানো হচ্ছে, দুর্গাপুজোয় অনুদান দেওয়া হচ্ছে, অথচ মুসলিমদের অধিকার নিয়ে কথা বললেই সমস্যা। শাসকদলের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে তাঁকে খুন করানোর আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন এই স্পষ্টবক্তা বিধায়ক।
তবে, যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে, তা হলো—ঠিক নির্বাচনের আগেই কেন তৃণমূল নেত্রী নড়েচড়ে বসলেন?
গত পাঁচ বছরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক সাম্প্রদায়িক গোলযোগের ঘটনা ঘটেছে। শমসেরগঞ্জ, বেলডাঙা, ধুলিয়ান, পাঁচলা , শ্যামপুকুর, রাজারহাট, ডায়মন্ড হারবারের মতো বহু জায়গায় সংঘটিত দাঙ্গার ঘটনায় শাসকদলের বহু নেতার প্রত্যক্ষ যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছিল। এমনকি, খোদ কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের বিরুদ্ধেও একটি সম্প্রদায়ের পক্ষে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের ধর্মান্তরিত করার জন্য আহ্বান জানানোর অভিযোগ উঠেছিল।
অথচ, ঠিক একই ধরনের ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক’ মন্তব্যের জন্য নির্বাচনের আগে ভরতপুরের তৃণমূল নেতাকে সাসপেন্ড করা হলো।
Indigo Airlines Flight Cancel : ইন্ডিগো বিপর্যয়ে কড়া কেন্দ্র: রাহুল গান্ধীর নিশানায় ‘একচেটিয়া মডেল’, মন্ত্রীর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ভোগান্তি
ভোটের আগে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র মুখোশ
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই পুরো ঘটনাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। নির্বাচনের আগে শাসকদলের প্রশাসনের মধ্যে যেন এক কৃত্রিম ধর্মনিরপেক্ষতার ভাব দেখা যায়, কিন্তু তার পরেই আবার শাসকদলের আইন মেনেই ‘তোষণ’ চলতে থাকে।
হুমায়ুন কবীরকে বহিষ্কার করে তৃণমূল নেতৃত্ব বিজেপি-কে শক্তিশালী হতে দেওয়ার ঝুঁকি এড়াতে চেয়েছেন—ফিরহাদ হাকিম এমনটা দাবি করলেও, প্রশ্ন ওঠে গত পাঁচ বছরে কেন এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো না? দলের এই আচরণের কারণ স্পষ্ট: হুমায়ুনের মতো নেতাকে সামনে রেখে রাজনীতি করলে বিজেপি বিরোধী মেরুকরণের সুবিধা পাবে। তাই নির্বাচনের প্রাক্কালে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার বার্তা দিয়ে প্রশাসনকে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে।
ইতিপূর্বে বহুবার হুমায়ুন কবীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, দল থেকে ছয় বছরের জন্য সাসপেন্ড হয়েছেন, অন্য দলে গিয়ে ফিরে এসেছেন—কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে ক্ষমা করে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন, কারণ সামনে নির্বাচন। তৃণমূলের এই সাসপেনশন কৌশলগত হলেও, দল যে তাকে তোষণ করবে না, এমন কোনো নজির বিগত বছরগুলিতে শাসকদল গড়েনি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদের সভা থেকে NRC বা ডিটেনশন ক্যাম্প রাজ্যে হতে দেবেন না বলে সংখ্যালঘু সমাজকে আশ্বাস দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখান করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, দলের নেতার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত কি কেবলমাত্র নির্বাচন পার করার কৌশল, নাকি দলীয় আদর্শে সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন?
হুমায়ুন কবীরের মতো নেতাকে বহিষ্কার করে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনোর পর তৃণমূল কংগ্রেস তাদের তোষণের রাজনীতি থেকে সরে আসে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।



















