ব্যুরো নিউজ ০৬ জুলাই ২০২৫ : ডেনিম বা জিন্স , যা আজ বিশ্বজুড়ে ফ্যাশনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার সূচনা কিন্তু মোটেই চাকচিক্যময় ছিল না। এই মোটা, টেকসই কাপড়টির শিকড় প্রোথিত দাসপ্রথা ও বর্ণবাদের গভীরে।
ডেনিমের জন্ম ও দাসপ্রথা
পশ্চিম আফ্রিকায় দাসশ্রেণীর মানুষদের মধ্যে এক ধরণের মোটা কাপড় বিতরণ করা হত, যা তারা ক্ষেত-খামার ও বাড়ির কাজে পরিধান করত। এই কাপড়টি কখনও ডেনিম, কখনও রুক্ষ সুতি বা লিনেন দিয়ে তৈরি হত এবং প্রকাশ্যে “নিগ্রো কাপড়” নামে পরিচিত ছিল। যদিও এর উদ্দেশ্য হিসেবে কাপড়ের দীর্ঘস্থায়িত্বের কথা বলা হত, মূল উদ্দেশ্য ছিল দাসদের সহজে চিহ্নিত করা ও নিয়ন্ত্রণ করা। এটি কেবল একটি পোশাক ছিল না, এটি ছিল দাসদের শ্রেণীগত পরিচয়ের প্রতীক। দাসদের নিজেদের পোশাক বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল না; ডেনিম ছিল তাদের জন্য এক ধরণের ইউনিফর্ম।
Baba Ramdev : ৫০ বছরেও নেই রোগ, চুল নিকশ কালো, জানুন যোগগুরু বাবা রামদেবের তারুণ্যের রহস্য
ডেনিমের ইউরোপীয় উৎস ও আফ্রিকায় আগমন
ডেনিমের উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যা হলো এটি ফ্রান্সের নিমস (Nîmes) শহরে ১৬শ শতাব্দীর শেষভাগে তৈরি হয়েছিল, যেখানে এটিকে “সার্জ ডি নিমস” (Serge de Nîmes) নামে ডাকা হত, যার অর্থ ‘নিমস থেকে আসা কাপড়’। আবার কেউ কেউ ইতালির জেনোয়া (Genoa) শহরকেও এর উৎস হিসেবে দাবি করেন, যেখানে নাবিকরা ‘জিনোয়েজ’ (genoese) নামক এক ধরণের শক্ত কাপড় পরত, যা থেকে ‘জিন্স’ (jeans) শব্দটি এসেছে। ইউরোপে এই কাপড় শ্রমজীবী মানুষের জন্য ব্যবহৃত হত। উপনিবেশবাদের হাত ধরে, বিশেষ করে ১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে, ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা এই ডেনিমের মতো শক্ত, মোটা কাপড় পশ্চিম আফ্রিকায় নিয়ে আসে। দাসপ্রথার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই কাপড় দাসদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, যা তাদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় একটি উপাদান ছিল।
ডেনিমের বুনন ও পশ্চিম আফ্রিকার অবদান
আশ্চর্যজনকভাবে, আজ আমরা যে ব্লু ইন্ডিগো জিন্স দেখি, তার বুনন ও ডাইং প্রক্রিয়া পশ্চিম আফ্রিকার ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্লু ডেনিমের রঙের সৌন্দর্য এবং এর পেছনের প্রযুক্তি অনেক অংশেই দাসদের নিজস্ব আবিষ্কার ছিল। তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ এই কাপড়ের বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত হয়েছিল। এর কয়েক দশক পর, ১৮৭৩ সালে, লেভি স্ট্রস এবং জ্যাকব ডেভিস যে ব্লু জিন্স পেটেন্ট করেন, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছিল এই দাসদের হাতেই।
উল্লেখ্য , সেই সময়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে এই নীল ( ইন্ডিগো) চাষের বিরোধিতায় গড়ে উঠেছিল বিপ্লব এবং প্রতিবাদ – যা ভারতের সমৃদ্ধ কৃষি সমাজকে ঊপনিবেশকদের ভৃত্যতে পরিণত করেছিল ।
ডেনিমের বিবর্তন: শ্রমিকের পোশাক থেকে ফ্যাশন আইকন
সময়ের সাথে সাথে ডেনিম কেবল একটি নির্দিষ্ট স্টাইলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি প্রতিনিয়ত বিকশিত হয়েছে। কাউবয়রা তাদের কঠোর পরিশ্রমের উপযোগী পোশাক হিসেবে ডেনিমকে গ্রহণ করে। এরপর কারখানার শ্রমিকরাও ডেনিমকে আপন করে নেয়, যা তাদের দৈনন্দিন কাজের জন্য উপযুক্ত ছিল।
কবি, শিল্পী, কর্মী, সঙ্গীতজ্ঞ—বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্ণবাদ এবং দাসপ্রথার বিরুদ্ধে পরিবর্তনকামী মানুষদের দৈনন্দিন পোশাকে পরিণত হয় ডেনিম। এটি কেবল একটি পোশাক ছিল না, এটি প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
Amrapali : আমগাছের নিচে পরিত্যক্ত শিশুকন্যা ‘আম্রপালী’ , ইতিহাসের বিস্ময়কর অধ্যায়
ডেনিমের প্রতিটি সেলাইয়ে লুকানো ইতিহাস
আজ ডেনিম সর্বত্র বিদ্যমান এবং আমরা এটিকে কেবল স্টাইলের জন্য পছন্দ করি। কিন্তু ডেনিমের প্রতিটি সেলাইয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ভুলে যাওয়া ইতিহাস—এক হৃদয়বিদারক গল্প। যখন আমরা ডেনিম পরি, তখন আমরা কেবল একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি করি না, বরং আমরা তাদের ঐতিহ্য বহন করি যাদেরকে বর্ণবাদ আর দাসত্বের পোশাক হিসেবে এটি পরতে বাধ্য করা হয়েছিল, যারা কখনও ডেনিমকে নিজের জন্য পছন্দ করে বেছে নিতে পারেনি। এই ইতিহাস স্মরণে রাখা ডেনিমের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও গভীর করে তোলে।