ব্যুরো নিউজ ০৬ অক্টোবর ২০২৫ : উত্তরবঙ্গে প্রবল বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ ধস ও বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ জন। যদিও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (NDRF) এবং দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের সংকলিত তথ্য অনুসারে সোমবার সকাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ২৩, তবে উদ্ধারকাজ চলমান থাকায় কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দার্জিলিং, কার্শিয়াং, এবং কালিম্পং সহ তিন পাহাড়ের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সবথেকে খারাপ অবস্থা মিরিকের।
এনডিআরএফ এবং জেলা প্রশাসনের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারসালি, জসবিরগাঁও, মিরিক বস্তি, ধরগাঁও (মেচি), নাগরাকাটা এবং মিরিক লেক এলাকা সহ বেশ কয়েকটি স্থান থেকে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহও জানিয়েছেন যে মৃতের সংখ্যা ২০ হলেও তা বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
রাজভবনে র্যাপিড অ্যাকশন সেল গঠন
পাহাড়, তরাই এবং ডুয়ার্স অঞ্চলের গুরুতর পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, বিপদে পড়া মানুষ ও পর্যটকদের কাছ থেকে সরাসরি ফোন পাওয়ার জন্য রাজভবনে (Governor’s House) একটি র্যাপিড অ্যাকশন সেল স্থাপন করা হয়েছে। এই সেলে একজন বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে নিয়োগ করা হয়েছে এবং একটি ডেডিকেটেড হেল্পলাইন নম্বর ও ইমেল আইডি চালু করা হয়েছে।
এছাড়াও, রাজভবনের ভেতরের ‘শান্তি কক্ষ’ (peace room) সক্রিয় করা হয়েছে, যা উদ্ধার হওয়া এবং কলকাতায় আনা দুর্গতদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন এবং সবাইকে শান্ত থাকতে এবং উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে প্রশাসনকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রী যাচ্ছেন উত্তরবঙ্গ, পর্যটকদের আশ্বাস
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ (সোমবার) উত্তরবঙ্গের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তিনি আটকে পড়া পর্যটকদের উদ্দেশে বলেছেন, তারা আপাতত যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন। প্রশাসন তাদের উদ্ধারে সবরকম চেষ্টা করছে। মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন যে এই সঙ্কটকালে হোটেল ও লজগুলি যেন পর্যটকদের ওপর অতিরিক্ত থাকার খরচের জন্য চাপ না দেয়, তা প্রশাসন দেখবে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশনা দিয়েছেন যেন তারা সহানুভূতি ও প্রতিশ্রুতির সাথে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ান, সমর্থন করেন ও সহায়তা করেন।
বিজেপি সাংসদের ‘রাজ্য-স্তরের বিপর্যয়’ ঘোষণার দাবি
দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের দুইবারের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্টা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে পাহাড়, তরাই এবং ডুয়ার্স অঞ্চলে চলমান এই সঙ্কটকে “রাজ্য-স্তরের বিপর্যয়” (state-level disaster) হিসেবে ঘোষণা করার অনুরোধ করেছেন।
তিনি ৪ এবং ৫ অক্টোবরের রাতে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি, রাস্তা ও সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ক্ষতি, এবং কৃষিজমি ও জীবিকার ধ্বংসের বিষয়টি চিঠিতে তুলে ধরেছেন।
বিজেপি সাংসদ মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্রীয় সরকারকে উত্তরবঙ্গের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করেছেন, যাতে অতিরিক্ত সম্পদ পাওয়া যায়। তিনি তিস্তার বন্যা (২০২৩)-কে রাজ্য সরকার ‘বিপর্যয়’ ঘোষণা না করায় ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সমস্ত ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে কেন্দ্রের সাথে রাজ্যকে সহযোগিতার ওপর জোর দেন।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও ডুয়ার্সের অবস্থা
প্রবল ধসের কারণে দার্জিলিং সহ একাধিক এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। একাধিক জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ। সিকিম এবং মিরিকের সাথে যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন। ভুটান ও পাহাড়ে ভারী বৃষ্টির কারণে তিস্তা ও তোর্সার মতো নদীগুলি ফুঁসছে।
বৃষ্টিতে শুধু পাহাড়ই নয়, তরাই এবং ডুয়ার্সও তিস্তা-তোর্সার জলে ভাসছে। জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারেও বন্যা পরিস্থিতি। জলপাইগুড়ির নাগেরকাটা, গয়েরকাটা এলাকায় নদীর জল জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে বইছে, ভাসিয়ে নিয়ে গেছে চাষের জমি ও ঘরবাড়ি। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন ত্রাণ শিবিরে।
শিলাবতী নদীর প্রকোপে ঘাটাল ফের জল মগ্ন , ডুবল ভিত্তিহীন মাস্টার প্লান
ধূপগুড়ির বাসিন্দাদের ক্ষোভ, ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ
অন্যদিকে, বন্যা কবলিত ধূপগুড়ির বাসিন্দাদের কাছ থেকে তীব্র অভিযোগ আসছে। ধূপগুড়ির মাগুরমারীর ২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ আলতা গ্রাম ভাটিয়া পাড়ায় জলঢাকা নদীর বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৩০০ মানুষ রাত কাটানোর জন্য ১০টি ত্রিপল পেলেও, সকাল থেকে থাকা-খাওয়ার হাহাকার শুরু হয়েছে। গ্রামবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ নথি, খাদ্য এবং জামাকাপড় নষ্ট হয়েছে।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, “থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, কাগজপত্র হারিয়ে গেছে, বেঁচে আছি এটাই ভাগ্য ভালো। মাথায় দেওয়ার ত্রিপল পর্যন্ত পাইনি, রান্না করার কোনো ব্যবস্থা নেই, জামা কাপড় আসবাব সমস্ত জলে ভেসে গেছে।” আরও অনেকে জানিয়েছেন যে প্রশাসনিক বা সরকারি সাহায্য এখনও পৌঁছায়নি। তাদের দাবি, “প্রশাসনিক তরফ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। বানভাসি হওয়াতে ১০০ টি পরিবার পিছু মাত্র ১৪-১৫ টি ত্রিপল পাওয়া গেছে। ধানি জমি, ফসল, গবাদি পশু সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত। আসবাব, নথি সমস্ত ভেসে চলে গেছে, খালি প্রাণটি বেঁচে ফিরেছে।” গ্রামবাসীরা অবিলম্বে ত্রাণ ও পানীয় জলের দাবি করছেন।
উদ্ধার কাজ ও বন্যপ্রাণীর দুর্দশা
বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গে পুরোদমে উদ্ধারকাজ শুরু করেছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর তিনটি দল। তারা কয়েকজন মৃতদেহ উদ্ধার করেছে, আহতদেরও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। স্রোতে সেতু, কালভার্ট ভেসে গেছে এবং একাধিক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে।
পাহাড় ও ডুয়ার্সে বৃষ্টির কারণে বন্যপ্রাণীরাও বিপর্যস্ত। জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে পৌঁছে গেছে হাতির দল, এবং নদীতে গণ্ডার ভেসে আসার খবরও পাওয়া গেছে। বাকি বন্যপ্রাণীদের অবস্থা শোচনীয়।



















