ব্যুরো নিউজ ২১ মে : প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হলো ৭ মে, ২০২৫ তারিখে কলকাতা হাইকোর্টে। বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রত কুমার মিত্রের নবগঠিত ডিভিশন বেঞ্চে এই বহু প্রতীক্ষিত মামলার শুনানি শুরু হয়েছে, যা ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
মামলার প্রেক্ষাপট: ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার ভিত্তিতে ২০১৬ সালে রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একক বেঞ্চ ২০২৩ সালের মে মাসে প্রায় ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তার রায়ে উল্লেখ করেন যে, এই নিয়োগে অনেক প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীকে যথাযথ ইন্টারভিউ বা অ্যাপটিটিউড টেস্ট ছাড়াই নিয়োগ করা হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করেন, এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ লাভ করেন। মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ালেও, শীর্ষ আদালত তা পুনরায় কলকাতা হাইকোর্টেই ফেরত পাঠায় দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়ে।
৭ মে’র শুনানি ও বেঞ্চ পরিবর্তন: গত ৭ এপ্রিল এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও, ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বিচারপতি সৌমেন সেন এই মামলা থেকে সরে দাঁড়ানোয় শুনানি স্থগিত হয়ে যায়। এরপর প্রধান বিচারপতি টি.এস. শিবজ্ঞানম নতুন করে বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রত কুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার শুনানির দায়িত্ব দেন। ৭ মে, ২০২৫ তারিখে এই নতুন বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়।
বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা:
শুনানির শুরুতেই বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী মামলার গুরুত্বের উপর জোর দেন। তিনি মন্তব্য করেন, “বহু শিক্ষকের ভবিষ্যৎ এই মামলার ফলাফলের উপর নির্ভরশীল। বেঞ্চকে এই বিষয়টি বিশদে শুনতে হবে। আইনজীবীদের একটি বৃহৎ দল তাদের পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করবে। ৭ মে শুনানি শুরু হবে।” এটি মামলার জটিলতা এবং এর ব্যাপক প্রভাবের প্রতি তার স্বীকৃতির ইঙ্গিত দেয়।
আদালত আরও নির্দেশ দেয় যে, যাদের বক্তব্য এবং ইস্যু একই, তাদের আইনজীবীরা একজন প্রধান প্রতিনিধির নেতৃত্বে সওয়াল করবেন। এটি আদালতের মূল্যবান সময় সাশ্রয় করে শুনানি প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করার একটি প্রচেষ্টা।
৭ মে’র শুনানিতে, যখন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত প্রশ্ন তোলেন যে, কীভাবে পূর্ববর্তী একক বেঞ্চ (বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়) এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে নিয়োগগুলো অর্থের বিনিময়ে হয়েছিল, তখন বিচারপতি চক্রবর্তী মন্তব্য করেন যে, “দুর্নীতি সম্পর্কিত একটি মামলায়, সংশ্লিষ্ট বিচারকের নিজস্ব উপলব্ধি সবসময় থাকতে পারে।” এই মন্তব্যটি বোঝায় যে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় একজন বিচারকের নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টি এবং বিচারিক উপলব্ধি একটি ভূমিকা পালন করতে পারে, এমনকি যদি নগদ লেনদেনের সরাসরি, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান নাও হয়।
এছাড়াও, বেঞ্চ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্ত প্রাসঙ্গিক নথি জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলকেও প্রাসঙ্গিক নথিগুলির একটি সফট কপি জমা দিতে বলা হয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের সওয়াল: রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের হয়ে সওয়াল করেন। তিনি দাবি করেন যে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছু অনিয়ম হয়ে থাকলেও, এটিকে সরাসরি ‘দুর্নীতি’ বলা যায় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, কেবল “দুর্নীতি” বললেই তা প্রমাণিত হয় না; দুর্নীতি প্রমাণ করতে হলে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে হবে এবং অবৈধ আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিও প্রমাণ করতে হবে। অ্যাটর্নি জেনারেলের সওয়াল, “ক্ষমতার অপব্যবহার ‘দুর্নীতি’-র সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না।” তিনি আরও যুক্তি দেন যে, মামলাকারীরা শুরু থেকেই চাকরি বাতিলের আবেদন করেননি, বরং প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীদের নিয়োগ নিয়েই তাদের আপত্তি ছিল।
সিবিআই তদন্ত ও সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ: এই মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (সিবিআই) তদন্ত চালাচ্ছে। সিবিআই রাজ্যের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ার এবং প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগ করেছে। কলকাতা হাইকোর্ট সম্প্রতি রাজ্য পুলিশকে এই মামলার কেস ডায়েরি এবং অন্যান্য প্রমাণ এক সপ্তাহের মধ্যে সিবিআইকে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছে।
উল্লেখ্য, এই প্রাথমিক শিক্ষক মামলাটি রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বৃহত্তর অংশের একটি। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর নিয়োগ বাতিলের কলকাতা হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে। যদিও সুপ্রিম কোর্ট কিছু “অকলঙ্কিত” শিক্ষককে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে, তবে গ্রুপ সি ও ডি কর্মীদের জন্য এই সুবিধা মেলেনি। এই রায় প্রাথমিক শিক্ষক মামলার উপরও চাপ সৃষ্টি করছে।
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ: ৭ মে থেকে শুরু হওয়া এই মামলার শুনানি হাইকোর্টে অব্যাহত রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের পক্ষ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল দ্রুত এই মামলার নিষ্পত্তির আবেদন জানিয়েছেন। আগামী ১২ জুন এই মামলার পরবর্তী শুনানি ধার্য করা হয়েছে, যেখানে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল তার সওয়াল চালিয়ে যাবেন। এই মামলার রায় পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের কর্মজীবনের পাশাপাশি রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলবে।