ব্যুরো নিউজ ০৭ অক্টোবর ২০২৫ : দুই বছর আগে, ৭ অক্টোবর, ইহুদিদের সুকোট উৎসব চলাকালীন হামাস জঙ্গিদের চালানো আকস্মিক ও প্রাণঘাতী হামলার দ্বিতীয় বার্ষিকী পালন করছে ইসরায়েল। এই দিনটি ছিল দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী। হামাসের সেই আক্রমণের ফলে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ধারণা আমূল পাল্টে যায় এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
৭ অক্টোবরের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতির চিত্র
হামাস-নেতৃত্বাধীন জঙ্গিরা গাজা-ইসরায়েল সীমান্ত অতিক্রম করে দক্ষিণের ইসরায়েলি জনপদ এবং একটি উন্মুক্ত সংগীত উৎসবে হামলা চালায়। এই আক্রমণে:
- নিহত: প্রায় ১,২০০ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও সাধারণ নাগরিক।
- অপহৃত: ২৫১ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এদের মধ্যে ৪৮ জন এখনও বন্দি রয়েছে, যার মধ্যে ২৫ জনকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী মৃত ঘোষণা করেছে।
- আইডিএফ-এর ব্যর্থতা: সিমচাত তোরাহ উৎসব ও সাব্বাথের কারণে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (IDF) সেদিন প্রস্তুত ছিল না। ইসরায়েলি নেতৃত্ব হামলার গোয়েন্দা সতর্কতা উপেক্ষা করেছিল, যা তাদের অরক্ষিত করে তোলে।
দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ইসরায়েলের প্রস্তুতি ও শোক
হামলার দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে ইসরায়েল জুড়ে শোক ও স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
- সর্বোচ্চ সতর্কতা: আইডিএফ চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল আয়াল জামির চলমান সুকোট উৎসব জুড়ে সামরিক বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতা (Highest Level) জারি করার নির্দেশ দিয়েছেন।
- শোক অনুষ্ঠান: হামলার শিকার পরিবারগুলো তেল আবিবে মূল স্মরণসভার আয়োজন করেছে, যেখানে সঙ্গীত পরিবেশনা এবং বক্তৃতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন সরকার করেনি, যা প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের প্রতি দেশজুড়ে থাকা গভীর বিভেদকে প্রতিফলিত করে।
আঞ্চলিক সংঘাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতির মোড়
গত দুই বছরে ইসরায়েল তার সামরিক অভিযান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে, তেহরানসহ পাঁচটি আঞ্চলিক রাজধানীতে হামলা চালিয়েছে এবং হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ সহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র হামাস নেতাকে হত্যা করেছে। জুন মাসে ১২ দিনের এক যুদ্ধে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক কর্মসূচিতেও আক্রমণ চালায়। ইসরায়েলের শত্রুদের সামরিক সক্ষমতা বহুলাংশে কমেছে, এবং দেশটি গাজার বেশিরভাগ অঞ্চলসহ লেবানন ও সিরিয়ার কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
তবে, বন্দিদের মুক্ত করতে না পারায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সাপ্তাহিক গণবিক্ষোভ হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ইসরায়েল আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক ইসরায়েলি মনে করেন, নেতানিয়াহুর ব্যর্থতার কারণেই অবশিষ্ট বন্দিদের মুক্ত করা সম্ভব হয়নি , তবে বেশিভাগ ইহুদী সমাজ হামাস নামক সন্ত্রাসবাদী কলঙ্ককে বিলুপ্ত করে শান্তি চান। তারা মনে করেন সন্ত্রাসবাদীদের সাথে কোনও আপোষ নয় ।
শান্তি আলোচনা এবং ট্রাম্পের পরিকল্পনা
যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন। এই পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আবার গতি পেয়েছে:
- ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০-দফা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। এতে হামাস সমস্ত জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার সাথে সাথে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে। এর পরে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজা থেকে পর্যায়ক্রমে ইসরায়েলি প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে।
- মিশরে বৈঠক: ট্রাম্পের এই প্রস্তাব নিয়ে মধ্যস্থতাকারীদের উপস্থিতিতে সোমবার মিশরের শাম এল-শেখ রিসর্ট শহরে ইসরায়েল ও হামাসের প্রতিনিধিদের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা শুরু হয়েছে, যা মঙ্গলবারও চলার কথা।
- উভয় পক্ষ ট্রাম্পের প্রস্তাবকে প্রকাশ্যে স্বাগত জানালেও, এর জটিল বিবরণ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে।
গাজার মানবিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক অভিযোগ
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক আক্রমণে এ পর্যন্ত ৬৫,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন (হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী), যাদের প্রায় অর্ধেকই নারী ও শিশু।
- মানবিক সংকট: এই আক্রমণে গাজার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং মানবিক সহায়তার উপর বিধিনিষেধের কারণে মারাত্মক খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা সিটিতে বর্তমানে দুর্ভিক্ষ চলছে।
- আইনি অভিযোগ: বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার গোষ্ঠী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) যুদ্ধপদ্ধতি হিসেবে অনাহারে রাখার জন্য নেতানিয়াহু এবং তাঁর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে।
- ইসরায়েল এই অভিযোগগুলো তীব্রভাবে অস্বীকার করে এটিকে আত্মরক্ষার বৈধ যুদ্ধ বলে দাবি করছে এবং হতাহতের জন্য হামাসকেই দায়ী করছে।




















