নিজস্ব সংবাদদাতা ২৬ জুন: ১৫৮২ সালের ক্যালেন্ডার পরিবর্তন মানব সভ্যতার সময় গণনার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এই বছর থেকেই শুরু হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের যাত্রা, যা বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ অনুসরণ করে। এই পরিবর্তনটি শুধুমাত্র তারিখের হিসাব-নিকাশ নয়, বরং বিজ্ঞান, ধর্ম এবং রাজনীতির এক জটিল সমন্বয়ে গঠিত একটি সুদূরপ্রসারী সংস্কার ছিল।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সমস্যা
১৫৮২ সালের আগে ইউরোপে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হত, যা রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে প্রচলিত ছিল। এই ক্যালেন্ডারে প্রতি বছর প্রায় ১১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড অতিরিক্ত হিসাব করা হতো। এর ফলস্বরূপ, প্রতি ১২৮ থেকে ১৩০ বছরে প্রায় ১ দিন অতিরিক্ত যোগ হয়ে যেত। এই ক্রমপুঞ্জিত ত্রুটির কারণে খ্রিস্টানদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব, ইস্টার, প্রকৃত ঋতু এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের বসন্ত বিষুব (vernal equinox)-এর সঙ্গে তার সঙ্গতি হারাচ্ছিল। ইস্টার পালনের সঠিক তারিখ নির্ধারণে এই বিচ্যুতি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
রাজার পোশাকে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি
পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশের সংস্কার
এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশ ১৫৮২ সালের ৪ অক্টোবর একটি নতুন ক্যালেন্ডার ঘোষণা করেন। এই নতুন ক্যালেন্ডারটিই পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে “গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার” নামে পরিচিত হয়। এই ক্যালেন্ডার সংস্কারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল মাঝের ১০ দিন বাদ দেওয়া। অর্থাৎ, ১৫৮২ সালের ৪ অক্টোবর-এর ঠিক পরের দিনই হয়ে যায় ১৫৮২ সালের ১৫ অক্টোবর। এটি সূর্যবর্ষের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাখার জন্য এক যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল।
নতুন অধিবর্ষ (লিপ ইয়ার) নিয়ম
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে অধিবর্ষের নিয়ম কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছিল, যা ক্যালেন্ডারকে আরও সূক্ষ্ম ও যথাযথ করে তোলে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, প্রতি চার বছর অন্তর একটি অধিবর্ষ যোগ করা হতো। কিন্তু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এই নিয়মের সঙ্গে একটি নতুন শর্ত যুক্ত করা হয়: যে বছরগুলি ১০০ দ্বারা বিভাজ্য, সেগুলিকে অধিবর্ষ হিসাবে গণ্য করা হবে না, যদি না সেগুলি ৪০০ দ্বারাও বিভাজ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৭০০, ১৮০০, ১৯০০ সাল অধিবর্ষ ছিল না, কিন্তু ২০০০ সাল একটি অধিবর্ষ ছিল। এই সংশোধিত নিয়মটি ক্যালেন্ডারকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সৌরবর্ষের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে।
বাগবাজার: ইতিহাস, মনীষী আর সংস্কৃতির উত্তর কলকাতার মহাতীর্থ
ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী গ্রহণ
প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র ক্যাথলিক দেশগুলো পোপের নির্দেশ মেনে এই নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে। প্রোটেস্ট্যান্ট এবং অর্থোডক্স খ্রিস্টান দেশগুলো শুরুতেই এটি গ্রহণ করেনি, কারণ তারা এটিকে ক্যাথলিক গির্জার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হিসাবে দেখেছিল। তবে, সময় গণনার নির্ভুলতার কারণে ধীরে ধীরে বিশ্বের প্রায় সব দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ড এবং এর উপনিবেশগুলি (যেমন ভারত) ১৭৫২ সালে এই ক্যালেন্ডারে রূপান্তরিত হয়। রাশিয়াসহ কিছু দেশ আরও অনেক পরে এটি গ্রহণ করে।
প্রভাব ও গুরুত্ব
এই ক্যালেন্ডার পরিবর্তন কেবল দিনপঞ্জির একটি সংস্কার ছিল না; এটি মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষিকাজ, ধর্মীয় অনুশীলন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও গভীর প্রভাব ফেলে। সময়কে সঠিকভাবে বোঝার এবং বিশ্বব্যাপী সমন্বয় সাধনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য নির্ভুল পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ সুগম করে। সামগ্রিকভাবে, ১৫৮২ সালের ক্যালেন্ডার বিপ্লব মানবজাতির সময় ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
– লেখক মিঠুন