ব্যুরো নিউজ ২৮ মে : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামাত-ই-ইসলামির শীর্ষ নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম অবশেষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে পুরোপুরি খালাস পেয়ে গেলেন। যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ধর্ষণ, গণহত্যা ও পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করার মতো ভয়ঙ্কর অভিযোগ ছিল, তাঁকেই প্রায় ১১ বছর কারাবন্দী থাকার পর মঙ্গলবার (২৭ মে, ২০২৫) মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রাফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মত রায়ে ৭৩ বছর বয়সী আজহারুল ইসলামকে সকল অভিযোগ থেকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করে। সরকারি আইনজীবী নিশ্চিত করেছেন যে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং এটি বাতিল করার জন্য বাংলাদেশে বা আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে উচ্চতর আদালত নেই।
কে এই এ টি এম আজহারুল ইসলাম?
এ টি এম আজহারুল ইসলাম ছিলেন জামাত-ই-ইসলামির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রংপুর অঞ্চলে আলবদর বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, হত্যা এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করার মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়। ২০১৪ সালে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। ২০১৫ সালে তিনি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। তবে, আজহারুল ইসলাম ২০২০ সালে ১৪টি আইনি কারণ দেখিয়ে পুনর্বিবেচনা আবেদন দাখিল করেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতেই পুনরায় শুনানি হয় এবং মঙ্গলবার, ২০২৫ সালের ২৭ মে সর্বসম্মত রায়ে তাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
যুদ্ধাপরাধের বিচার: এক বিতর্কিত অধ্যায়
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বাংলাদেশে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনালের অধীনে বহু জামায়াত নেতা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়, যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ছয়জন সিনিয়র নেতা এবং একজন বিএনপি নেতাও ছিলেন।
তবে, সময়ের সাথে সাথে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে রাজনৈতিক লেনদেনের শিকার হতে শুরু করে বলে অনেকে মনে করেন। এ টি এম আজহারুলের খালাস সেই আশঙ্কাকেই যেন বাস্তবে রূপ দিল। প্রাক্তন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটি গত বছরের ছাত্র আন্দোলনের ফল, যা ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল। নজরুল সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, “ন্যায়বিচারের এই নতুন সম্ভাবনার কৃতিত্ব জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলনের নেতৃত্বের।” তিনি ইঙ্গিত দেন যে, নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিচার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে।
শহিদ পরিবার ও যুদ্ধাপরাধ বিরোধী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া
এ রায় শোনার পর থেকেই বাংলাদেশের শহিদ পরিবার এবং যুদ্ধাপরাধ বিরোধী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকেই হতবাক ও মর্মাহত হয়েছেন। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের সরকার ও বিচারব্যবস্থা কি তবে জামাতের মতো একটি কুখ্যাত ইসলামি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আপস করছে? সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশিষ্ট নাগরিকদের একাংশ মনে করছেন, জামাতকে খুশি করতেই এমন রায় এসেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে যারা বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের স্তম্ভ বলে মনে করেন, তাদের কাছে এই রায় একটি বড় আঘাত।
ভারতের জন্য সতর্কবার্তা
বাংলাদেশের এই ঘটনা ভারতের জন্যও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জামাতের সঙ্গে পাকিস্তানপন্থী শক্তির ঐতিহাসিক যোগ, সীমান্তবর্তী এলাকায় মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতা, এবং বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের মতো বিষয়গুলি ভারতের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের কারণ। যে দেশে ১৯৭১ সালের মতো ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি এত সহজে খালাস পেয়ে যায়, সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর দৃঢ়তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যায়। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে এই ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অঙ্গনে নতুন করে বিতর্ক ও বিভেদ তৈরি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই রায় ভবিষ্যতে দেশের বিচার ব্যবস্থা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের ধারণাকে কোন পথে নিয়ে যায়, এখন সেটাই দেখার বিষয়।