ব্যুরো নিউজ ৩১ মে : মানুষের মনে ভয় জাগানো হিংস্র সরীসৃপ কুমিরকে যখন পৃথিবীজুড়ে সকলে ভয় পায়, তখন ছত্তিশগড়ের ধামতরি জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বাবা মোহতারা (আগে যার পরিচিতি ছিল ‘কুমিরের গ্রাম’ বা ‘মগরমাছ ওয়ালা গাঁও’) এক ব্যতিক্রমী ভালোবাসার গল্প লিখেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে এই গ্রামের পুকুরের শান্ত বাসিন্দা, প্রায় ১৩০ বছর বয়সী কুমির গঙ্গারামের প্রয়াণে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী রইলো গোটা গ্রাম। গঙ্গারামের শেষকৃত্যে সামিল হয়েছিলেন পাঁচ শতাধিক গ্রামবাসী, যা মানব ও প্রকৃতির মধ্যে এক সুরেলা সহাবস্থানের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
গঙ্গারাম: শুধু একটি কুমির নয়, পরিবারের সদস্য এবং গ্রামের রক্ষক
সাধারণত, কুমির মানেই যেখানে মানুষের মনে আতঙ্ক, সেখানে বাবা মোহতারা গ্রামের চিত্রটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। গঙ্গারাম গত বহু দশক ধরে গ্রামের পুকুরে বসবাস করে আসছিল এবং আশ্চর্যজনকভাবে কখনও কোনো মানুষ বা প্রাণীর ক্ষতি করেনি। গ্রামবাসীদের মতে, গঙ্গারামকে তাদের পূর্বপুরুষরা ১০০ বছরেরও বেশি আগে উত্তরপ্রদেশ থেকে এনেছিলেন। গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা যখন পুকুরে মায়ের কাছে স্নান করত, গঙ্গারাম শান্তভাবে তাদের পাশ দিয়ে সাঁতার কেটে যেত। এমনকি যখন কেউ তার খুব কাছে চলে আসত, গঙ্গারাম নিজেই অন্য পাশে সরে যেত। গ্রামের মানুষ নির্ভয়ে এই পুকুর ব্যবহার করতেন, কারণ তারা জানতেন গঙ্গারাম তাদের বন্ধু, শত্রু নয়। গঙ্গারামের এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য গ্রামবাসীরাও তাকে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আগলে রেখেছিলেন। এটি নিছকই একটি প্রাণীর প্রতি মানুষের আচরণ ছিল না, বরং গঙ্গারামকে তারা নিজেদের পরিবারের একজন সদস্য এবং গ্রামের রক্ষক হিসেবেই দেখতেন, এমনকি তাকে ঈশ্বরের সমান সম্মানও করতেন।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
শোকে আচ্ছন্ন গ্রাম, অশ্রুসিক্ত শেষ বিদায়
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে গঙ্গারামের প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু হয়। তার প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেদিন গ্রামবাসীরা নিজেদের রান্নাঘরে আগুন জ্বালায়নি, কারণ তারা গঙ্গারামের শোকে আচ্ছন্ন ছিলেন। বন বিভাগের কর্মকর্তারা যখন গঙ্গারামের দেহ সংগ্রহ করতে এসেছিলেন, তখন গ্রামবাসীরা চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রতিবাদ করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন নিজেদের প্রথা অনুযায়ী গঙ্গারামের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে। বন বিভাগ তাদের ইচ্ছাকে সম্মান জানায় এবং ময়নাতদন্তের পর দেহ গ্রামবাসীদের হাতে তুলে দেয়।
প্রায় ৫০০ গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে গঙ্গারামের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন। একটি ফুলে সজ্জিত ট্র্যাক্টরে করে তার দেহকে শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামবাসীর চোখে ছিল অশ্রু, মুখে ছিল প্রিয় গঙ্গারামকে হারানোর বেদনা। গ্রামবাসীরা তার দেহ স্পর্শ করে আশীর্বাদ চেয়েছিলেন। এক শান্ত ও শোকপূর্ণ পরিবেশে গঙ্গারামকে তার শেষ শয্যায় শায়িত করা হয়।
স্মৃতির সন্মান : গঙ্গারামের সম্মানে স্মৃতিসৌধ ও মন্দির নির্মাণ
গঙ্গারামকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্রামবাসীরা গঙ্গারামের সম্মানে একটি মন্দিরও নির্মাণ করছেন। এই মন্দিরে গঙ্গারামের মূর্তির সঙ্গে দেবী নর্মদার মূর্তি থাকবে বলে জানা গেছে। এটি কেবল একটি কুমিরের সমাধি বা মন্দির নয়, এটি প্রকৃতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সহাবস্থানের প্রতীক। এটি প্রমাণ করে যে, যদি মানুষ চায়, তাহলে প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণীর সাথেও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা সম্ভব।
গঙ্গারামের অলৌকিক প্রকৃতি: বিজ্ঞানের সীমানা পেরিয়ে?
গঙ্গারামের এই অসাধারণ প্রকৃতিকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। কীভাবে এটি তার হিংস্র মৌলিক প্রবৃত্তিকে জয় করেছিল? মানুষসহ যে কোনো মাংসাশী প্রাণীর মাংসের প্রতি আকর্ষণ থাকে, কিন্তু এখানে এই কুমিরটি যেন নিজের বিবেক দ্বারা চালিত হয়ে ১৩০ বছরের জীবনকালে মানুষের মাংসের প্রতি তার সহজাত আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছে। এটি কি কোনো ঐশ্বরিক সত্তা ছিল, নাকি কোনো মানুষের আত্মা কুমির রূপে পুনর্জন্ম নিয়েছিল? উত্তরটি পাঠকের কাছেই থাক!
বাবা মোহতারা গ্রামের এই ঘটনাটি শুধু ছত্তিশগড় নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য এক অনুপ্রেরণা। এটি প্রমাণ করে যে, মানুষ এবং বন্যপ্রাণী একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বাস করতে পারে, যেখানে ভয় নয়, ভালোবাসাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। গঙ্গারামের স্মৃতি চিরকাল এই গ্রামের মানুষের মনে বেঁচে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানবতা ও প্রকৃতির গভীর বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দেবে।