ফুরফুরা শারিফ

ব্যুরো নিউজ ১০ জুন : পশ্চিমবঙ্গের তোষণ রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এই সংখ্যালঘু সমাজে ফুরফুরা শরিফের গভীর প্রভাব নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘ দিন ধরে ফুরফুরা শরিফের বিভিন্ন পীরজাদা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। কখনও সরাসরি, কখনও পরোক্ষভাবে—এই প্রভাব বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কৌশল নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়েছে। সম্প্রতি ফুরফুরার রাজনীতিতে এক নতুন মোড় দেখা যাচ্ছে, যেখানে কাশেম সিদ্দিকীর উত্থান এবং ফুরফুরা শরিফের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নতুন সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে।

কে এই কাশেম সিদ্দিকী?

কাশেম সিদ্দিকী ফুরফুরা শরিফের অন্যতম পীরজাদা। এতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিসরে তাঁকে খুব বেশি দেখা না গেলেও, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় এবং তারপর থেকে তিনি রাজ্য সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছিলেন। একসময় সিপিএম-এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার গুঞ্জনও শোনা গিয়েছিল। তুতো ভাই আব্বাস সিদ্দিকী যখন ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (ISF) গঠন করেন, তখন কাশেম তাঁকে সরাসরি সমর্থন করেন। এমনকি নওশাদ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করার পর কাশেম সিদ্দিকী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। এই ঘটনার পর হঠাৎ করে কাশেমকে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ হতে দেখা যাওয়ায় রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

আলিপুরদুয়ারের জনসভায় মোদীর বার্তা : ‘নির্মম সরকার’কে উপড়ে ফেলে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’র ডাক!

কাশেম সিদ্দিকীকে কেন তৃণমূলে?

তৃণমূল কংগ্রেস সম্প্রতি কাশেম সিদ্দিকীকে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ করেছে। তৃণমূলের প্রেস বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। দলীয় নেতাদের মতে, রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজে নতুন করে একটি প্রভাবশালী মুখ তুলে আনতেই কাশেমকে সামনে আনা হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এই সিদ্ধান্তের পিছনে তৃণমূলের স্পষ্ট কৌশল রয়েছে: ত্বহা সিদ্দিকীর বর্তমান ভূমিকা ও গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা দুর্বল, সেই ফাঁক পূরণ করতেই কাশেমকে সামনে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ফুরফুরা শরিফে নেতৃত্বের লড়াই ?

একদিকে ত্বহা সিদ্দিকী, অন্যদিকে কাশেম সিদ্দিকী—দুই শিবিরের দ্বৈরথে কি রাজনৈতিক সুবিধা তুলতে চাইছে ঘাসফুল শিবির? ত্বহা সিদ্দিকী ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “যে নবান্নকে সবাই চোর বলেছিল, সেই লোকই এখন মমতার পাশে।” এর পাল্টা হিসেবে কাশেম সিদ্দিকী বলেছেন, “ফুরফুরায় কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে একজনই। যিনি সবসময় চিৎকার করেন। তিনি কালো চশমা পরে থাকেন, তাই হয়তো সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পান না।”

নির্বাচনের আগে নতুন অঙ্ক

২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ঘিরে আবার নতুন করে জোর দিচ্ছে তৃণমূল। মুসলিম ভোটবিভাজন যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে চাইছে দল। আব্বাস ও নওশাদের আইএসএফ যেভাবে ২০২১-এ সংখ্যালঘু ভোট কেটে নিয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা নিয়েই এবার আরও আগেভাগে প্রস্তুতি নিচ্ছে তৃণমূল। এই প্রেক্ষাপটে কাশেম সিদ্দিকীর উত্থান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ফুরফুরা সফরে তাঁকে কাশেমের পাশে দেখা গেছে, যেখানে ত্বহা কিংবা আব্বাস-নওশাদ ছিলেন না। পার্ক সার্কাসের ইফতারেও একই চিত্র দেখা গেছে।

ত্বহার প্রভাব কি কমছে?

ত্বহা সিদ্দিকী বরাবর তৃণমূলপন্থী ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তৃণমূলের অন্দরেও মনে করা হচ্ছে, তাঁর সঙ্গে কাজ করা সহজ নয়। কাশেম সিদ্দিকী সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন কি না, তা ভবিষ্যতই বলবে। তবে আপাতত তৃণমূল পরিষ্কারভাবে বার্তা দিচ্ছে—ফুরফুরা শরিফে নতুন মুখ, নতুন ভরসা কাশেম সিদ্দিকী। আর এই সিদ্ধান্তই সম্ভবত বদলে দিতে চলেছে ফুরফুরার রাজনীতি।

ফুরফুরা শরিফের গোষ্ঠী বিবাদ প্রকাশ্যে

ফুরফুরা শরিফের গোষ্ঠী বিবাদ সম্প্রতি ফের প্রকাশ্যে চলে এসেছে। পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি মঙ্গলবার আর এক পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকিকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। হুগলিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি আব্বাস সিদ্দিকিকে ‘জোকার’ এবং ‘বাচ্চা ছেলে’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, আব্বাস সিদ্দিকী ‘পরিবারের নামে কলঙ্ক’ এবং সার্কাসে জোকার যেমন মানুষের মনোরঞ্জন করে, আব্বাস তেমনই রাজনীতির ময়দানে মনোরঞ্জন করতে এসেছেন। ত্বহা সিদ্দিকী বারবার রাজ্যের সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন যে বিভাজনকারীদের কোনো মতেই এখানে জায়গা করে দেওয়া হবে না।

এর আগে ত্বহা সিদ্দিকী অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (AIMIM বা মিম) প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসিরও কড়া সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর কটাক্ষ ছিল, ওয়েইসির বাইরের সাদা কাপড় থাকলেও ভিতরে রয়েছে গেরুয়া রঙ। এছাড়াও তিনি আব্বাস সিদ্দিকিকে ‘মিথ্যাবাদী’ এবং ‘বেইমান’ বলেও অভিযোগ করেছেন।

মোদী, শুভেন্দু এবং মমতার তরজা : ‘নির্মম সরকার’ এবং ‘সিঁদুর’ রাজনীতিতে উত্তাল বাংলা

ফুরফুরা শরিফ উন্নয়ন পর্ষদের নতুন ভবন

উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান বদলের পর এবার নতুন ভবন পেতে চলেছে ফুরফুরা শরিফ উন্নয়ন পর্ষদ। এতদিন শ্রীরামপুরের দফতর থেকে পর্ষদের কাজকর্ম পরিচালিত হতো। তবে এবার ফুরফুরা শরিফ গ্রাম পঞ্চায়েত দফতরের পাশেই তৈরি হচ্ছে নতুন ভবন। আগামী ২৪ মার্চ পর্ষদের বৈঠকে নতুন দফতরের উদ্বোধন নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে সূত্র মারফত জানা গেছে। হঠাৎ করে এই ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত কেন, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি পীরজাদা তথা ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর গ্রেফতারিকে ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেস তথা রাজ্য সরকারের সঙ্গে ফুরফুরা শরিফের একাংশের সম্পর্কে উত্থান-পতন দেখা দেয়। অন্যদিকে, সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূলের পরাজয়ের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই কারণেই তড়িঘড়ি এই ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

যদিও ফুরফুরা শরিফ উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান তপন দাশগুপ্ত এই যুক্তি মানতে নারাজ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা হয়েছিল। কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে। এর সঙ্গে ভোটের হিসাব জোড়া অর্থহীন।” প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফুরফুরা শরিফের জন্য উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করেছিলেন। সেই সময়েই পর্ষদের অফিস করা হয়েছিল শ্রীরামপুরে। সম্প্রতি ফিরহাদ হাকিমকে সরিয়ে পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে তপন দাশগুপ্তকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর