ব্যুরো নিউজ ১৩ আগস্ট ২০২৫ : নয়ডার সেক্টর ৭০-এর একটি সাদামাটা একতলা বাড়ি। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে যেন একটি সাধারণ অফিস। কিন্তু গত সপ্তাহ পর্যন্ত এর সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “INTERNATIONAL POLICE & CRIME INVESTIGATION BUREAU” এবং পুলিশের মতো একটি প্রতীকও লাগানো ছিল। এই ভুয়ো কার্যালয়ের আড়ালে ছয়জন প্রতারকের চক্র চালাচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা বিভাস চন্দ্র অধিকারী। নয়ডা পুলিশ এই চক্রের পর্দাফাঁস করে বিভাস অধিকারী সহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
প্রতারণার জাল: কলকাতা থেকে নোয়েডা পর্যন্ত
পুলিশ জানিয়েছে, এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং মানবাধিকার সংস্থার ছদ্মবেশে মানুষকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছিল। এই চক্রের মূল হোতা বিভাস, যিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের নলহাটির বাসিন্দা। সম্প্রতি তারা তাদের প্রতারণার জাল কলকাতা থেকে নয়ডায় বিস্তার করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু নয়ডা পুলিশের অভিযানে তা ব্যর্থ হয়।
নয়ডার কার্যালয়ে পুলিশ হানা দিয়ে জাল নথি, স্ট্যাম্প এবং একাধিক ওয়েবসাইট আবিষ্কার করে। এই ওয়েবসাইটগুলোর মাধ্যমে তারা নিজেদের “ইন্টারপোল”, “ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন” এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করত। বিভাসের এই ভুয়ো সংস্থা “অনলাইন অনুদান”-এর নামে মানুষের থেকে টাকা নিত। বিভাসের ছেলে অর্ঘ্য, “ন্যাশনাল ব্যুরো অফ সোশ্যাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড সোশ্যাল জাস্টিস (NBSISJ)” নামে আরেকটি ভুয়ো সংস্থা চালাত, যা মূলত সামাজিক ন্যায়বিচার সংক্রান্ত ভুয়ো খবর প্রচার করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করার চেষ্টা করত।
ভুয়ো সমন ও হুমকি
পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, এই চক্রটি ভুয়ো সংস্থাগুলোর নামে সম্পত্তি বা নির্মাণ সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়ে “সমন”-এর মতো চিঠি পাঠাত। এই চিঠিগুলোতে আদালতের ভাষার ব্যবহার করা হতো এবং স্বঘোষিত “ডেপুটি সেক্রেটারি” ও “চিফ অ্যাডভাইজার”-এর স্বাক্ষর থাকত। কিছু চিঠিতে অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারকদের সঙ্গে যোগাযোগের দাবিও করা হতো। এই চিঠিগুলোতে সিল, কেস নম্বর দেওয়া থাকত এবং প্রাপককে “শুনানির” জন্য হাজির হতে বলা হতো।
নয়ডার কার্যালয় থেকে পুলিশ বিভিন্ন মন্ত্রকের (যেমন: উপজাতি বিষয়ক, আয়ুষ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন) নামে জাল সার্টিফিকেট, ভুয়ো প্রেস কার্ড, “মানবাধিকার কমিশন” আইডি কার্ড এবং রাবার স্ট্যাম্প উদ্ধার করেছে।
বিভাস অধিকারীর তৃণমূল যোগ
বিভাস অধিকারী একসময় বীরভূমের নলহাটি ব্লকের তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর সেই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এবং সিবিআই এর আগেও তাকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ২০২২ সালে তার কলকাতার বাড়িটি ইডি একটি অর্থ পাচার মামলায় সিল করে দিয়েছিল।
বিভাসের বিপুল আর্থিক সম্পত্তির মালিক। তিনি চারটি কলেজের মালিক, যার মধ্যে একটি আয়ুর্বেদিক কলেজ এবং একটি বিএড কলেজ রয়েছে। তিনি নলহাটিতে একটি সৎসংঘের আশ্রম এবং একাধিক ওষুধ কোম্পানির মালিক। জানা গেছে, তিনি গ্রেপ্তার হওয়া প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
কলকাতায়ও ছিল জাল অফিস
নয়ডায় গ্রেপ্তারের পর কলকাতা পুলিশ শহরের বেলেঘাটা এবং মানিকতলা এলাকায় বিভাসের আরও দুটি ভুয়ো অফিসের সন্ধান পেয়েছে। বেলেঘাটার একটি বাড়ির দোতলায় তিনি মাসিক ৪০,০০০ টাকা ভাড়ায় একটি অফিস চালাতেন, যার বাইরে “ইন্টারপোল” লেখা সাইনবোর্ড ছিল। স্থানীয়দের মতে, ওই অফিসে সশস্ত্র দেহরক্ষীসহ নীল বাতি লাগানো গাড়ি প্রায়ই আসা-যাওয়া করত, যা এলাকায় এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছিল। এই ঘটনায় পুলিশ বিভাস অধিকারী ও তার ছেলে সহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং আরও তদন্ত চলছে।