ব্যুরো নিউজ ২৯ জুলাই ২০২৫ : পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি দিল্লিতে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি পরিবারকে মারধরের অভিযোগ তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও পোস্ট করার পর রাজ্য রাজনীতিতে নতুন করে শোরগোল শুরু হয়েছে। এই ভিডিও এবং তাঁর করা অভিযোগকে সম্পূর্ণ ‘মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে খারিজ করেছে দিল্লি পুলিশ, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে FIR দায়েরের দাবি তুলেছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ: ‘বাঙালিদের বিরুদ্ধে ভাষাগত সন্ত্রাস’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে মালদার চাঁচলের এক পরিযায়ী পরিবারের সদস্য, একটি শিশু এবং তার মাকে দিল্লি পুলিশের নির্মমভাবে মারধর করার অভিযোগ করেন। তিনি লেখেন, “জঘন্য!! ভয়াবহ!! দেখুন দিল্লি পুলিশ কীভাবে মালদার চাঁচলের এক পরিযায়ী পরিবারের সদস্য একটি শিশু এবং তার মাকে নির্মমভাবে মারধর করেছে। দেখুন কীভাবে বিজেপির বাঙালিদের বিরুদ্ধে ভাষাগত সন্ত্রাসের শাসনামলে একটি শিশুও হিংসার নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না! তারা এখন আমাদের দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”
মুখ্যমন্ত্রী আরও অভিযোগ করেন যে, ভিন রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার চলছে এবং তাদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে বিতাড়িত করার চেষ্টা হচ্ছে। এমনকি কয়েকজনকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার প্রতিবাদে তিনি ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকেও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি ও কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেছিলেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যজুড়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে। কলকাতা, হুগলির চুঁচুড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সোমবার বীরভূমেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে কর্মসূচিতে অংশ নেন।
মুখ্যমন্ত্রী পোস্টে একটি ভিডিও সংযুক্ত করেন, যেখানে একটি শিশুকে দেখা যায় যার কানে ক্ষত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ভিডিওতে একজন ব্যক্তি দাবি করছেন যে, পুলিশ তাঁর ছেলেকে মারধর করেছে, তার কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে এবং তাদের সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে দিয়েছে। তিনি এও দাবি করেন যে, পুলিশ তাঁর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং তাঁকেও মারধর করা হয়েছে। এই অভিযোগের পর চাঁচল থানার আইসি জানিয়েছেন যে, মুখ্যমন্ত্রীর পোস্টের পরই তারা নড়েচড়ে বসেছেন এবং তদন্তের জন্য টিম পাঠানো হয়েছে, যদিও এখনও কোনো লিখিত অভিযোগ জমা পড়েনি।
Suvendu vs Mamata : বাঙালি বিদ্বেষ বিতর্কে মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা । বাস্তব চিত্র কিরকম ?
দিল্লি পুলিশের পাল্টা দাবি: ‘ভিডিও মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’
তবে, মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি সম্পূর্ণভাবে খারিজ করে দিয়েছেন পূর্ব দিল্লি পুলিশের ডিসিপি অভিষেক ধানিয়া। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবিকে ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার’ বলে অভিহিত করেছেন। দিল্লি পুলিশ দাবি করেছে, মালদার এক রাজনৈতিক কর্মী তথা এক আত্মীয়ের প্ররোচনায় এই ‘ভিত্তিহীন ভিডিও’টি তৈরি করা হয়েছে।
ডিসিপি অভিষেক ধানিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, “স্থানীয় গোয়েন্দার মাধ্যমে সেই ভিডিওর ভিত্তিতে তদন্তে নামে দিল্লি পুলিশ। নানা প্রযুক্তিগত পরীক্ষানিরীক্ষাও করা হয় এবং সেই ভিত্তিতেই একাধিক প্রমাণ জড়ো করে তদন্তকারী দল। সেই প্রমাণ নথির ভিত্তিতে আমরা ওই ভিডিওতে দেখানো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করি। তখনই আসল সত্যিটা বেরিয়ে আসে। আমরা জানতে পারি, ওই পরিবার ভিডিওটা তৈরি করেছিল তাদের এক আত্মীয়র কথায়। যাকে আবার নির্দেশ দিয়েছিল মালদহের এক নেতা এবং পশ্চিমবঙ্গের কোনও এক সাংবাদিক । এই ভিডিও সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
শুভেন্দু অধিকারীর তোপ: মিথ্যাচারে ‘আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতে পারেন মমতা!’
দিল্লি পুলিশের এই তথ্যের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মুখ্যমন্ত্রীকে তীব্র নিশানা করেছেন। শুভেন্দু অধিকারীর সাফ কথা, “গুজব এবং মিথ্যে খবর রটাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কারণে তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পর্যন্ত পেতে পারেন!” বিরোধী দলনেতা আরও বলেন, “দিল্লিতে বাঙালি হেনস্থার যে অভিযোগ মমতা করেছেন তা যে ভুয়ো সেটা প্রমাণিত। মালদার এক তৃণমূল নেতার ইন্ধনে ওই ভিডিও করা হয়েছিল। এতেই পরিষ্কার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ভুয়ো, মিথ্যে খবর রটাচ্ছেন। এর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে FIR দায়ের হওয়া উচিত।”
নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী আরও জানান যে, দিল্লিতে থাকা বাঙালিদের উচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সব ভুয়ো পোস্টের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে FIR করা। পাশাপাশি তিনি দিল্লি পুলিশকেও সেই FIR এর ভিত্তিতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এও জানিয়েছেন যে, তিনি কাঁথির সাংসদ সৌমেন্দু অধিকারীকে ফোনে বলেছেন, মঙ্গলবার সংসদের অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর দিল্লি পুলিশের সাইবার সেলে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে FIR দায়ের করতে।
উপসংহার: এক সাংবিধানিক সংঘাতের আশঙ্কা
পশ্চিমবঙ্গে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR) বা ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়াকে ঘিরে রাজ্য সরকারের বাঙালি-অবাঙালি সমীকরণের যে ‘নোংরা রাজনীতি’ শুরু হয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গকে গোটা দেশের কাছে ‘লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে’ নিয়ে যাচ্ছে। রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘মিথ্যাচার’ সামলাতে রাজ্যের প্রশাসনকে বারবার আদালতের হেনস্থা হতে হচ্ছে এবং এই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের প্রশাসনের তরফে আইনি পদক্ষেপের আশঙ্কা বাড়ছে। শুধুমাত্র একটি তৃণমূল শাসিত রাজ্য সরকারের তোষণ নীতির কারণে একটি সাংবিধানিক সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে । এই ঘটনা নিঃসন্দেহে আগামী দিনে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলবে এবং বঙ্গীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে ।