ব্যুরো নিউজ ১৪ অক্টোবর ২০২৫ : দুর্গাপুরে এক মেডিকেল ছাত্রীর গণধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই ঘটনায় তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) সরকারের ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করেছে।
সোমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী রাজ্যের পুলিশের তদন্তের ওপর “আস্থা নেই” বলে মন্তব্য করেন এবং জানান যে তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন ও ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছেন।
এক্স (X)-এ এক কঠোর পোস্টে শুভেন্দু অধিকারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরোনো এক মন্তব্য (মেয়েদের রাতে বাইরে যাওয়া উচিত নয়) টেনে এনে লেখেন যে, সরকার তাদের “প্রশাসনিক ব্যর্থতা” ঢাকতে “ভিকটিম-শেমিং” কে “রাষ্ট্রীয় নীতি” বানিয়েছে। তিনি আরজি কর, কসবা ল কলেজ, পানসকুরা হাসপাতাল বা দুর্গাপুরের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বারবার ঘটে চলা যৌন অপরাধের কথা উল্লেখ করে সরকারের “সংশোধনী ব্যবস্থা নিতে অক্ষমতা” তুলে ধরেন।
পরিবারের উদ্বেগ ও রাজ্যপালের পরিদর্শন
সোমবার শুভেন্দু অধিকারী ওড়িশার বাসিন্দা নির্যাতিতা ছাত্রীর পরিবারের সাথে দেখা করেন। তিনি বলেন, “ওড়িশা থেকে যে যুবতী এখানে পড়তে এসেছিল, আমরা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।” তিনি জানান, নির্যাতিতার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
পরিবার তাঁকে জানিয়েছে যে, তারা মেয়ের ভর্তির জন্য ৮০ লক্ষ টাকা দিয়েছে, কিন্তু বর্তমানে তারা তাকে দুর্গাপুরে আর পড়াতে চান না। শুভেন্দু অধিকারী আরও প্রশ্ন তোলেন, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন মাঝি ফোন করে খোঁজ নিলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন নির্যাতিতার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেননি। তিনি অভিযোগ করেন যে, তাঁকে নির্যাতিতার চিকিৎসকদের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং এই তদন্ত “নির্বাচিত” মনে হচ্ছে, কারণ চারজন গ্রেপ্তার হলেও “মূল অভিযুক্ত এখনও অধরা”।
অন্যদিকে, ঘটনার প্রায় ৬০ ঘণ্টা পর সোমবার সন্ধ্যায় রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস দুর্গাপুরের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে হাসপাতালের চিকিৎসক এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেন, “বাংলায় একসময় নবজাগরণ হয়েছিল, এখন সময় এসেছে যে রাজ্য আরও একটি নবজাগরণ দেখতে চায়। বাংলায় নারী সুরক্ষিত নয় ”
কলেজ কর্তৃপক্ষের বিবৃতি ও ছাত্রীর অবস্থা
রাজ্যপালের পরিদর্শনের আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে ছাত্রীর অবস্থা “স্থিতিশীল” বলে দাবি করে। আইকিউ সিটি মেডিকেল কলেজের ডিরেক্টর ড. সুদর্শনা গাঙ্গুলি জানান, ছাত্রীর ভাইটাল সাইন স্বাভাবিক রয়েছে এবং সে ধীরে ধীরে সুস্থতার পথে। যদিও চিকিৎসকরা নির্যাতিতার গোপনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন বলে সূত্র মারফত জানা গেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাংসদ সৌগত রায়ের হোস্টেল নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগের পর কলেজ কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট করেছে যে, সংশ্লিষ্ট দুই দ্বিতীয় বর্ষের এমবিবিএস ছাত্র কোনো নিয়ম ভাঙেননি এবং ঘটনার সময় তারা ক্যাম্পাসের ভিতরেই ছিলেন।
তবে, হাসপাতাল চত্বরে চলমান আন্দোলনের জেরে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হাসপাতালের কার্যকারিতা ব্যাহত হচ্ছে এবং রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রথম পেশাদার এমবিবিএস পরীক্ষা চলছে এবং এই অস্থিরতার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না।
তদন্তের গতি ও আইনি ধারা
পুলিশ এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণ এবং সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে জড়ো হওয়ার (ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৭০(১) ও ৩(৫) ধারা) অভিযোগ আনা হয়েছে। ৭০(১) ধারায় ২০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
দুর্গাপুরের ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ (ডিসি) অভিষেক গুপ্ত বলেছেন, “মেয়েটির বিবৃতিতে কোনও অসঙ্গতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। বরং সে আমাদের সহযোগিতা করছে।” যদিও সরকার পক্ষের আইনজীবী দেবব্রত সাইন জানিয়েছেন, পুলিশের সন্দেহ যে আরও অনেকে এই ষড়যন্ত্র বা প্রতিশোধের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এবং তাই অভিযুক্তদের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।
ডিসি আরও জানান, অভিযুক্তদের একজনের কাছ থেকে নির্যাতিতার মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা হয়েছে এবং অন্য অভিযুক্তের কল ডিটেইলস পরীক্ষা করে বাকিদের শনাক্ত করা হয়েছে। এই ঘটনা দুর্গাপুরের মতো একটি শিক্ষা কেন্দ্রের ভাবমূর্তিকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।