Sukanto Majumdar Chandrima Bhattacharya BJP TMC

ব্যুরো নিউজ ২৪ জুন : দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দির ঘিরে প্রথম রথযাত্রা উৎসবের প্রাক্কালে রাজ্যের রাজনীতিতে নতুন করে বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে। রাজ্য বিজেপি সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার এই মন্দিরকে ‘বিনোদন পার্ক’ আখ্যা দেওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস তীব্র আক্রমণ শানিয়েছে। তবে এই আক্রমণের আড়ালে তৃণমূলের নিজস্ব কিছু স্ববিরোধী অবস্থান প্রকট হয়ে উঠেছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে।

“বিনোদনের” তকমা নিয়ে বিতর্ক

সুকান্ত মজুমদার দিঘার জগন্নাথ মন্দিরকে নিছক “অ্যামিউজমেন্ট পার্ক” বলার পর তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁর উপর চড়াও হন। তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সুকান্তকে “হিংসা ও হীনমন্যতায়” ভুগছেন বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন যে এই মন্দির “ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য”। অন্যদিকে, ডা. শশী পাঁজা সুকান্তর মন্তব্যকে “লক্ষ লক্ষ হিন্দুর উপর আক্রমণ” বলে অভিহিত করেন, যারা মন্দিরে এসে পূজা দিয়েছেন ও প্রসাদ গ্রহণ করেছেন।

আলিপুরদুয়ারের জনসভায় মোদীর বার্তা : ‘নির্মম সরকার’কে উপড়ে ফেলে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’র ডাক!

তৃণমূলের নিজস্ব “নকল” থিম ও স্ববিরোধিতা

সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অতীতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জনপ্রিয় স্থাপত্য ও বিনোদনমূলক থিমের অনুকরণ করেছে। যেমন:

  • রাজারহাটের মাদার্স ওয়্যাক্স মিউজিয়াম লন্ডনের মাদাম তুসোর অনুকরণ।
  • লেকটাউনের ক্লক টাওয়ার লন্ডনের বিগ বেনের প্রতিরূপ।
  • ইকো পার্ক কমপ্লেক্সে মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের অনুকরণে বিভিন্ন স্থাপত্য নির্মিত হয়েছে।
  • এবং বর্তমান বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু দিঘার জগন্নাথ কালচারাল কমপ্লেক্স, যা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে তৈরি।

এই প্রেক্ষাপটে, সুকান্ত মজুমদার যখন দিঘার জগন্নাথ কমপ্লেক্সকে “ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণতার চেয়ে বেশি বিনোদনমূলক” বলে মন্তব্য করেন, তখন তা সম্পূর্ণ ভুল বলা যায় না। তৃণমূল সরকার নিজেই যখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক থিমের অনুকরণে নির্মাণকাজ চালিয়েছে, তখন একটি বৃহৎ মন্দিরের অনুকরণকে “বিনোদন” বা “পর্যটন আকর্ষণ” হিসেবে দেখাটা তাদের নিজস্ব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এখানে সুকান্তর মন্তব্যকে কেবলমাত্র রাজনৈতিক আক্রমণ হিসেবে দেখলেও, তৃণমূলের এই ধরনের “নকল” থিম পার্ক তৈরির প্রবণতা তাদের যুক্তির দুর্বলতা প্রকাশ করে।

ধর্মীয় সর্বজনীনতা বনাম হিন্দুত্বের উপর আক্রমণ: তৃণমূলের ভিন্ন সুর

ডা. শশী পাঁজা সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্যকে “লক্ষ লক্ষ হিন্দুর উপর আক্রমণ” বলে উল্লেখ করেন। অথচ তাঁরই উচ্চপদস্থ নেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য একই সঙ্গে দাবি করেন যে দিঘার এই নতুন স্থাপত্যটি “ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য”। এই দুটি মন্তব্য সরাসরি বিপরীতমুখী। একদিকে “সকলের জন্য” বলে ধর্মীয় সর্বজনীনতার বার্তা, অন্যদিকে “হিন্দুদের উপর আক্রমণ” বলে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগকে সামনে আনা – তৃণমূলের এই দ্বিমুখী অবস্থান তাদের রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এটি স্পষ্টতই শাসক দলের মধ্যে একটি সমন্বয়হীনতা অথবা প্রয়োজন অনুযায়ী অবস্থান বদলের ইঙ্গিত দেয়।

সুকান্ত মজুমদারের “সোনাগাছি” মন্তব্য ও তৃণমূলের আক্রমণ

সাম্প্রতিককালে সুকান্ত মজুমদার রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের সমালোচনা করতে গিয়ে “সোনাগাছির ওয়ার্কারে”র সঙ্গে তুলনা করেন। এই মন্তব্য তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং তৃণমূল এই ভাষাকে “ঘৃণ্য” ও “নিম্নরুচির” আখ্যা দিয়ে সুকান্তের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষ ও নোংরামির অভিযোগ তোলে। কুণাল ঘোষ সুকান্তকে “মা-বোনদের কাছে ক্ষমা চাইতে” বলেন এবং “মধ্যযুগে বাস করেন” বলে কটাক্ষ করেন।

পুলিশ ও যৌনকর্মী প্রসঙ্গে তৃণমূলের অতীত ও বর্তমান অবস্থান

সুকান্ত মজুমদার যখন তাঁর মন্তব্যের সাফাই দিতে গিয়ে অনুব্রত মণ্ডলের অতীতের বিতর্কিত মন্তব্যের প্রসঙ্গ টানেন, তখন তৃণমূলের ভণ্ডামি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুকান্ত বলেন যে, “যারা পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত তাদেরও নীতি আছে, কিন্তু কলকাতা পুলিশের নেই।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, “তৃণমূল কংগ্রেসের লোকেরা যারা পুলিশের মা এবং স্ত্রীকে গালিগালাজ করে, যারা আমার মাকে গালিগালাজ করে, তারা আমার উপর প্রশ্ন তুলছে?”
এখানে অনুব্রত মণ্ডলের সেই ঘটনাটি উল্লেখ্য, যখন তিনি বোলপুরের আইসি-কে ফোনে হুমকি দিয়েছিলেন, যা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় হয়েছিল এবং জাতীয় মহিলা কমিশনও রিপোর্ট চেয়েছিল। তৃণমূল তখন অনুব্রতকে সতর্ক করে এবং পরে তিনি চিঠি দিয়ে ক্ষমাও চান।
এখন, যখন সুকান্ত মজুমদার “সোনাগাছি” বা “পতিতাবৃত্তি” শব্দ ব্যবহার করছেন, তখন তৃণমূল অত্যন্ত তীব্রভাবে তার নিন্দা করছে এবং এটিকে নারীবিদ্বেষী বলে অভিহিত করছে। অথচ, অনুব্রত মণ্ডল যখন পুলিশকে সরাসরি হুমকি দিয়েছিলেন এবং তাদের পরিবারকে জড়িয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করেছিলেন, তখন তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া এতটা তীব্র ছিল না। বরং তখন বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এটি স্পষ্টতই দেখায় যে তৃণমূলের নৈতিক মানদণ্ড তার নিজের দলের নেতাদের ক্ষেত্রে একরকম এবং বিরোধী দলের নেতাদের ক্ষেত্রে অন্যরকম।

মোদী, শুভেন্দু এবং মমতার তরজা : ‘নির্মম সরকার’ এবং ‘সিঁদুর’ রাজনীতিতে উত্তাল বাংলা

উপসংহার

দিঘার জগন্নাথ মন্দির বিতর্ক থেকে শুরু করে সুকান্ত মজুমদারের ব্যক্তিগত মন্তব্য নিয়ে তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া – প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাসক দলের মধ্যে এক ধরনের দ্বিমুখী নীতি এবং স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে তারা ধর্মীয় সর্বজনীনতার কথা বলছে, আবার অন্যদিকে “হিন্দুদের উপর আক্রমণ” বলে ভোটারদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে, কুরুচিকর মন্তব্যের নিন্দা করার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব দলের নেতাদের প্রতি যে নমনীয়তা, বিরোধীদের প্রতি তার সম্পূর্ণ বিপরীত কঠোরতা – যা রাজ্যের রাজনৈতিক বিতর্কে তৃণমূলের “ভণ্ডামি”কে স্পষ্ট করে তুলেছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই বিষয়গুলি জনমানসে কতটা প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর