শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, আপনি এক মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন – শ্রীগীতায় ধর্ম ভাবনা

ব্যুরো নিউজ ৩০ মে : কোনোও এক মুহূর্তে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার ধারণাটি আমাদের মনে আসে। হয়তো বন্ধুদের সাথে কফি খেতে বসে, সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে, অথবা নিজের চিন্তাভাবনার সাথে একা বসে থাকার সময়েও এই প্রশ্নটি উঁকি দেয়। অর্থের সন্ধান, আমরা কেন এখানে আছি, কেন আমরা এভাবেই বিদ্যমান—এই প্রশ্নগুলো সর্বজনীন। এর কোনো সহজ, তৈরি উত্তর নেই। কিন্তু যখন আমরা বাইরের স্বীকৃতি খোঁজা বন্ধ করি, যখন সাফল্য বা সুখের তথাকথিত ছাঁচে নিজেদের জীবনকে মাপার চেষ্টা বন্ধ করি, তখন আমরা হয়তো আরও প্রকৃত, আরও নিজেদের সত্যিকারের সত্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু খুঁজে পাই। এই “কিছু”, যাকে প্রায়শই ধর্ম বলা হয়, তা কেবল একটি মহৎ, দার্শনিক ধারণা নয় — এটি একটি দিকনির্দেশক যন্ত্র। এমন একটি দিকনির্দেশক যন্ত্র যা আপনাকে অন্যের মানচিত্র অনুসরণ করতে বাধ্য করে না, বরং আপনাকে আপনার নিজের পথ তৈরি করার আমন্ত্রণ জানায়।

ধর্ম: কোনো গন্তব্য নয়, বরং এক জীবনযাপনের পদ্ধতি

অন্যের ধারণার প্রতিফলন না হয়ে, নিজের প্রকৃত সত্তা হয়ে উঠুন। ধর্মের ধারণা কেবল মহৎ আধ্যাত্মিক গ্রন্থ বা দূরবর্তী আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি কোনো সুদূর লক্ষ্য অর্জনের বিষয় নয়, যেখানে সবকিছু অলৌকিক ভাবে ঠিক হয়ে যাবে। এটি তার চেয়েও সহজ — এবং গভীর। ধর্ম হলো প্রতি মুহূর্তে আপনার প্রকৃত সত্তার সাথে একাত্ম থাকা, গভীরভাবে এবং সততার সাথে। এটি কোনো শেষ নয়, বরং একটি অবিরত উন্মোচন। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যা ‘কিছু করার’ প্রতি আচ্ছন্ন। কিছু অর্জন করার, কোথাও পৌঁছানোর। কিন্তু ধর্ম এসবের পরোয়া করে না। এটি নিজেকে প্রমাণ করার বিষয় নয়। এটি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে এবং নির্দ্বিধায় বিকশিত করার বিষয়, কাউকে মুগ্ধ করার প্রয়োজন ছাড়াই, এমনকি নিজেকেও নয়।

যখন আপনি আপনার ধর্ম অনুসরণ করেন, তখন কী ঘটে? ঠিক আছে, এটি কোনো রূপকথা নয় যেখানে সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক হয়ে যায়। জীবন তখনও তার নিজস্ব বিশৃঙ্খলা নিয়ে থাকবে। কিন্তু আপনি জীবনের তাল খুঁজে পাবেন, একটি নীরব স্পষ্টতা যা আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এমনকি যখন পথ অস্পষ্ট থাকে তখনও। আপনাকে এটি খুঁজে বের করার জন্য তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আসলে, এটি খুঁজে বের করার জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করাই এটিকে হারানোর দ্রুততম উপায়। ধর্ম আবিষ্কৃত হয় সেই মুহূর্তগুলোতে যখন আপনি ‘চেষ্টা করা’ বন্ধ করেন এবং ‘হয়ে ওঠা’ শুরু করেন।

পুণ্যকর্ম কেন শাস্তি মনে হয়? গীতার আলোকে আত্মিক বিশ্লেষণ

নিখুঁততার ভ্রান্তি: ‘উচিত’ ধারণা থেকে মুক্তি

উদ্দেশ্য নিখুঁত নয়; এটি বাস্তব, পরিবর্তনশীল এবং ক্রমবিকাশমান।

নিজের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়ার ধারণার সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো এর একটি নিখুঁত সংস্করণ থাকার বিশ্বাস। আমাদের শেখানো হয় যে একবার আমরা আমাদের উদ্দেশ্য খুঁজে পেলে, আমরা স্থিতিশীল হয়ে যাব, যেন আমরা হঠাৎ করে একটি ত্রুটিহীন, নিখুঁত জীবনযাপন করব। কিন্তু এটি সেভাবে কাজ করে না। ধর্ম নিখুঁততার বিষয় নয়। আসলে, এটি অসম্পূর্ণতার মধ্যেই বিকশিত হয়। এটি এই সত্যকে মেনে নেওয়া যে আপনি ভুল করবেন, আপনি হোঁচট খাবেন, এবং এর কোনটিই আপনার মূল্য বা আপনার উদ্দেশ্যকে হ্রাস করে না।

আমাদের সবচেয়ে প্রকৃত সংস্করণগুলি কখনই পালিশ করা হয় না। তারা বিশৃঙ্খল, ক্রমবিকাশমান, ক্রমাগত পরিমার্জনশীল। যখন আমরা নিজেদেরকে “কী হওয়া উচিত” এর অসম্ভব মানদণ্ডের সাথে তুলনা করা বন্ধ করি, তখন আমরা “আমরা কে” তা আবিষ্কারের দরজা খুলে দিই। ধর্ম নিজেকে সাফল্য বা সুখের কোনো আদর্শ সংস্করণে মানিয়ে নেওয়ার বিষয় নয়। এটি আপনি কে, আপনার সমস্ত বিরোধিতা, ত্রুটি এবং অমসৃণ দিকগুলি সহ, তা বোঝা এবং উপলব্ধি করা এবং নিজেকে বিশ্বের কাছে প্রস্তাব রাখার জন্য তৈরি।

ধর্ম ও স্বাধীন ইচ্ছা: পছন্দের ক্ষমতা

ধর্ম সচেতনভাবে পছন্দ করার বিষয়, নিষ্ক্রিয়ভাবে অপেক্ষা করা নয়।

ধর্ম ভাগ্যের বা নিয়তির ব্যাপার নয়। আমরা প্রায়শই জীবনকে এমন একগুচ্ছ ঘটনা হিসাবে ভাবি যা আমাদের বোধগম্যতার বাইরের শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই বিশ্বাসে এক ধরণের স্বস্তি আছে – এটি আমাদের দায় থেকে মুক্তি দেয়, যেন সবকিছু একটি পূর্বলিখিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হওয়ার এই অনুভূতিটি একটি বিভ্রম। ধর্ম কোনো বাহ্যিক শক্তি দ্বারা ভেসে যাওয়ার বিষয় নয়। এটি পছন্দ করার বিষয়। এটি আপনার নিজের জীবনকে চালিত করার দায়িত্বের বিষয়, আপনার অন্তর্নিহিত সত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়।

এটি কোনো চিহ্ন বা ঐশ্বরিক সংকেতের জন্য অপেক্ষা করার বিষয় নয়। এটি নিজের ভেতরে তাকানোর, আপনার সাথে কী অনুরণিত হয় তা খুঁজে বের করার এবং সেই জায়গা থেকে কাজ করার বিষয়। পৃথিবী সর্বদা আপনার পথে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে — প্রত্যাশা, চাপ, তুলনা। কিন্তু ধর্ম মনে করিয়ে দেয় যে, এই সব সত্ত্বেও, আপনার নিজের পথ বেছে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। এটি কোলাহলের উপর নিজের উপর বিশ্বাস রাখার পছন্দ। এটি অন্যের মতামত যাই হোক না কেন, আপনার মূল্যবোধ এবং বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ করার পছন্দ।

ধর্মের ক্রমবিকাশমান প্রকৃতি

আপনার উদ্দেশ্য আপনার বৃদ্ধি এবং পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়।

এখানে এমন কিছু আছে যা আমরা প্রায়শই উপেক্ষা করি: আপনার ধর্মীয় অনুভূতি স্থির নয়। এটি এককালীন আবিষ্কার নয়। এটি একটি অবিরত বিবর্তন, একটি প্রক্রিয়া যা আপনার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হবে। ২৫ বছর বয়সে আপনি যে ধর্ম গ্রহণ করেন, ৪০ বছর বয়সে আপনি হয়তো সেভাবে জীবনযাপন করবেন না। এটি কোনো ব্যর্থতা নয়। এটি বৃদ্ধি। আমরা পরিবর্তিত হই, এবং তাই আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াও পরিবর্তিত হওয়া উচিত।

আমরা নিজেদের পুরোনো সংস্করণের সাথে আঁকড়ে থাকতে পারি না, যা আমরা ভেবেছিলাম আমাদের হওয়া উচিত। আসলে, নিজেদের উদ্দেশ্যের পুরোনো ধারণাকে খুব শক্তভাবে ধরে রাখা আমাদের প্রয়োজনীয় বৃদ্ধিকে দমিয়ে দিতে পারে। ধর্ম নমনীয়তা দাবি করে। এটি আমাদের বিকশিত হতে আমন্ত্রণ জানায়, নতুন চোখে বিশ্বকে দেখতে, নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে, এবং নিজেদের সম্পর্কে এবং আমাদের যা প্রয়োজন সে সম্পর্কে আরও জানার সাথে সাথে আমাদের পথকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে।

ধর্ম এবং সামঞ্জস্যের কলা , অর্জনের নয়

প্রশংসা বা সাফল্যের মাপকাঠির জন্য নয়, সত্যের সাথে বাঁচুন।

অর্জন—তালিকা তৈরি করা এবং মাইলফলক সংগ্রহ করার প্রতি আচ্ছন্ন একটি বিশ্বে—ধর্ম আরও সূক্ষ্ম কিছু দাবি করে: সামঞ্জস্য। এটি আপনি কতটা সঞ্চয় করেন বা আপনি কতটা প্রমাণ করেন তার উপর নির্ভর করে না। এটি এমন একটি জীবনযাপন করার বিষয় যা আপনার কাছে সত্য মনে হয়, তা সমাজের মাপকাঠিতে যতই পরিমাপ করা হোক না কেন।

বেদে মাংস ভক্ষণের সমর্থন নেই – প্রমাণসহ তথ্য !

যখন আপনি আপনার ধর্মের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখেন, তখন আপনার বাহ্যিক স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় না। আপনি যে কাজ করেন, যে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং যেভাবে জীবনযাপন করেন তা সবই এক ধরণের নীরব নিশ্চিতি থেকে আসে। আপনার মূল্য চিৎকার করে বলার বা অনুমোদনের খোঁজার প্রয়োজন নেই কারণ আপনি গভীরভাবে জানেন যে আপনার জীবন যেমন আছে তেমনই অর্থপূর্ণ। ধর্ম আপনার নিজের জীবনে উপস্থিত থাকার বিষয়ে, অন্যদের প্রভাবিত করার বা সাফল্যের প্রত্যাশিত ছাঁচে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করার বিষয়ে নয়।

ধর্ম একটি দৈনন্দিন অনুশীলন, চূড়ান্ত উত্তর নয়

তাহলে, এটি আপনাকে কোথায় নিয়ে যায়? সম্ভবত, আপনার এখনও প্রশ্ন থাকবে। এবং এটি ঠিক আছে। ধর্ম সুনির্দিষ্ট উত্তরগুলির বিষয় নয়। এটি প্রতিদিন নিজেকে প্রকাশ করার অনুশীলন, এমন পছন্দগুলি করার যা প্রকৃত বলে মনে হয়, অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠিক থাকার এবং বিশ্বাস করা যে, সময়ের সাথে সাথে, আপনার উদ্দেশ্য নিজেই প্রকাশ পাবে। আপনি একদিনেই সবকিছু বুঝে ফেলবেন না। আর আপনার সবকিছু বুঝার কথাও নয়। ধর্ম কোনো গন্তব্য নয়। এটি সেই পথ যা আপনি হাঁটেন, যে পছন্দগুলি আপনি করেন, এবং সেই নীরব সাহস যা আপনার প্রকৃত সত্তার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে লাগে, একবারে একটি ছোট পদক্ষেপ। নিশ্চিততার প্রয়োজন ছেড়ে দিন। নিখুঁততার প্রয়োজন ছেড়ে দিন। এবং নিজেকে সেই স্থান দিন যেখানে আপনি হয়ে উঠবেন যা আপনি হওয়ার জন্য তৈরি। শেষ পর্যন্ত, ধর্ম সবকিছু সঠিকভাবে করার বিষয়ে নয়। এটি নিজের পথে কাজ করার বিষয়ে, এমনকি যখন আপনার চারপাশের পৃথিবী বলে যে কেবল একটিই সঠিক পথ আছে। এবং সেটাই, নিজেই যথেষ্ট।