ব্যুরো নিউজ ৪ জুন : বিশ্বজুড়ে কোভিড অতিমারী এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে দীর্ঘকাল থমকে থাকার পর, ঐতিহ্যবাহী দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে (DHR), যা ‘টয় ট্রেন’ নামেই সমধিক পরিচিত, ভারতীয় রেলের নিরন্তর বিনিয়োগ ও প্রচেষ্টায় নতুন জীবন লাভ করেছে। পর্যটনকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং পাহাড়ের স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে DHR এবার নতুন রূপে হাজির হচ্ছে। আসন্ন “DHR সামার ফেস্টিভাল ২০২৫ ” এবং এর সঙ্গে যুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব পাহাড়ি পর্যটনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে।
DHR সামার ফেস্টিভাল: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বিনোদন
ভারতীয় রেলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে এবার ৮ জুন থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত ‘DHR সামার ফেস্টিভাল ২০২৫’-এর আয়োজন করতে চলেছে। ভারতের উচ্চতম রেলস্টেশন ঘুম (Ghoom Station) এই বহুমুখী সাংস্কৃতিক উৎসবের প্রধান ভেন্যু হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। উৎসবে থাকছে নাচ, গান, কবিতা, আঁকা, ফটোগ্রাফি, বিভিন্ন ওয়ার্কশপ এবং DHR-এর সমৃদ্ধ ইতিহাস ঘিরে বিশেষ প্রদর্শনী। উৎসবের সবচেয়ে বড় চমক হিসেবে সিনেমাপ্রেমীদের জন্য নতুন সংযোজন করা হয়েছে DHR ইউনিভার্সাল মোশন আর্টস ফিল্ম ফেস্টিভাল (DHUMA)। এটি ১৪ জুন কার্শিয়াঙের আরপিএস বয়েজ হাই স্কুলে অনুষ্ঠিত হবে। DHR-এর ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনো ফিল্ম ফেস্টিভাল আয়োজন করা হচ্ছে, যা একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। DHR ডিরেক্টর ঋষভ চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “এই উৎসবের মূল লক্ষ্য হলো পাহাড়ের সংস্কৃতি ও পর্যটনকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরা। DHUMA আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।”
আগামী মাসেই কৈলাস মানস সরোবর যাত্রা সূচনা
বাচ্চাদের জন্যও থাকছে বিশেষ আকর্ষণ। কার্শিয়াঙের অ্যালিসিয়া প্যালেসে (Alicia Palace) আয়োজিত হবে শিশুদের আঁকা ও স্থিরচিত্র প্রতিযোগিতা, যেখানে বিজয়ীদের জন্য আকর্ষণীয় পুরস্কার ও নগদ অর্থ প্রদান করা হবে।
ভারতীয় রেলের বিনিয়োগ ও পুনরুজ্জীবনের গল্প
কোভিড অতিমারী এবং পাহাড়ি ধসের কারণে দীর্ঘদিন ধরে টয় ট্রেন পরিষেবা বন্ধ ছিল, যার ফলে স্থানীয় পর্যটন ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের মন্দা দেখা দিয়েছিল। তবে, ভারতীয় রেলওয়ে এই ঐতিহাসিক হেরিটেজ রেলের পুনরুজ্জীবনে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। ইঞ্জিন এবং কোচগুলির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, ট্র্যাক মেরামত এবং বিভিন্ন পর্যটন-বান্ধব উদ্যোগের মাধ্যমে DHR-কে আবারও সচল করে তোলা হয়েছে। ‘উইন্টার ফেস্টিভাল ‘-এর ব্যাপক সাফল্যের পরেই এবারের ‘সামার ফেস্টিভাল’-এর আয়োজন করা হচ্ছে, যা DHR-এর ঘুরে দাঁড়ানোর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভারতীয় রেলের এই বিনিয়োগ এবং কর্মযজ্ঞ শুধু পর্যটকদের জন্য নয়, স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রাতেও ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য DHR কর্তৃপক্ষ বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। ফেস্টিভালের মাধ্যমে পাহাড়ি হস্তশিল্প, স্থানীয় খাবার, লোকসংস্কৃতি এবং পরিবেশ সচেতনতা আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে তুলে ধরাই প্রধান উদ্দেশ্য। বিভিন্ন দেশের ব্লগার, ট্রাভেল ভ্লগার এবং পর্যটকরা ইতিমধ্যেই এই উৎসব নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, যা দার্জিলিংয়ের পর্যটন অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রবীণ নাগরিকদের জন্য কেন্দ্রের ঐতিহাসিক ঘোষণা: ১৫ জুন থেকে সারাদেশে বিনামূল্যে ভ্রমণের সুবিধা
এনজেপি থেকে দার্জিলিং: একটি নস্ট্যালজিক যাত্রা ও তার গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলো
নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত টয় ট্রেনের যাত্রা এক নস্ট্যালজিয়ার অনুভূতি নিয়ে আসে। ইউনেস্কো হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃত এই রেললাইন আপনাকে নিয়ে যাবে পাহাড়ি সৌন্দর্য আর কুয়াশার দেশে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে ট্রেনটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে থামে, যেখানে পর্যটকরা প্রকৃতির শোভা উপভোগ করার পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন:
- শুরু এনজেপি (New Jalpaiguri) স্টেশন থেকে: এনজেপি স্টেশন থেকে শুরু হয় টয় ট্রেনের প্রায় ৭-৮ ঘণ্টার ধীরগতির সফর, যা প্রকৃতির প্রতিটি সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ করে দেয়।
- শিলিগুড়ি জংশন (Siliguri Junction): শহরের শেষ স্টেশন, যেখানে হালকা নাস্তা ও পানীয় কেনার সুযোগ মেলে।
- সুকনা (Sukna): জঙ্গলের কোলে ছোট্ট এই স্টেশনে গরম চা আর মুড়ি-আলুর চপ পাওয়া যায়।
- রংটং (Rongtong): এই স্টেশন থেকে পাহাড়ি পথে প্রবেশ শুরু হয়, জানালার বাইরে দেখা যায় সবুজ পাহাড়, চা-বাগান আর ঝরনার দৃশ্য।
- তিনধারিয়া (Tindharia): পুরনো স্টিম ইঞ্জিনের গন্ধ মাখা এই স্টেশনে ছোট রেলওয়ে মিউজিয়াম এবং পাহাড়ি হস্তশিল্পের দোকান রয়েছে।
- গয়াবাড়ি (Gayabari): কুয়াশার রাজ্য হিসেবে পরিচিত এই স্টেশনে পাহাড়ি চকোলেট ও লজেন্স চেখে দেখতে পারেন।
- মহানদী (Mahanadi): এই স্টেশনের আশেপাশেই সেরা ভিউ পয়েন্টগুলো রয়েছে, যেখানে টেরেসড চা-বাগান দেখা যায় এবং খাস্তা কচুরি ও চায়ের কম্বো উপভোগ করা যায়।
- কার্শিয়াং (Kurseong): চায়ের শহর হিসেবে পরিচিত এটি অন্যতম বড় স্টপ, যেখানে দুপুরের খাবার এবং বিখ্যাত দার্জিলিং চা পাওয়া যায়।
- টুং (Tung): ছোট এই স্টেশনে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের দৃশ্য মন মুগ্ধ করে তোলে।
- দার্জিলিং (Darjeeling): সব শেষে টয় ট্রেন দার্জিলিং স্টেশনে পৌঁছায়, যেখানে চারপাশের কুয়াশা, পাহাড়ি হাওয়া এবং সহজেই ম্যাল, চৌরাস্তা বা টাইগার হিলে পৌঁছানোর সুবিধা রয়েছে।
ভারতীয় রেলওয়ের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং ডিএইচআর-এর এই উৎসব আয়োজন দার্জিলিংয়ের পর্যটনকে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা পাহাড়ের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও সহায়ক হবে।