ব্যুরো নিউজ ৩০ মে : গত ২২শে এপ্রিল পহেলগামে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছিল। এই হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ভারত ৭ই মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে এক কৌশলগত অভিযানে নেমে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট সন্ত্রাসী অবকাঠামো লক্ষ্য করে নির্ভুল সামরিক হামলা চালায়। ভারতের এই পদক্ষেপের পরদিন, অর্থাৎ ৮, ৯ এবং ১০ই মে পাকিস্তান ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালানোর চেষ্টা করে। ভারতীয় পক্ষও পাকিস্তানের এই উস্কানিমূলক পদক্ষেপের জোরালো জবাব দেয়, যা উভয় দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছে দেয়। এই সময়েই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের চীনা-নির্মিত অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার করে।

চীনা অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন: অক্ষত PL-15E ক্ষেপণাস্ত্রের রহস্য

ভারত-পাক সংঘাতের রেশ কাটতে না কাটতেই ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসে। জানা যায়, ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে একটি অক্ষত PL-15E ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, যা চীনের তৈরি একটি রাডার-গাইডেড, বিয়ন্ড-ভিজ্যুয়াল-রেঞ্জ (BVR) মিসাইল। বিমান যুদ্ধের ক্ষেত্রে BVR ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তুকে দীর্ঘ দূরত্ব থেকে আঘাত করতে সক্ষম, যা আধুনিক সামরিক সক্ষমতার এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া তার কার্যকারিতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করে। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, পাকিস্তানের ব্যবহৃত চীনা অস্ত্র ব্যবস্থাগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যাশিত মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি এবং তাদের কার্যকারিতা ‘গড়পড়তা’র নিচে ছিল।

এই গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সিনিয়র কর্নেল ঝাং জিয়াওগ্যাং-কে প্রশ্ন করা হলে, তিনি সরাসরি উত্তর এড়িয়ে যান। তিনি শুধু বলেন:

তার এই জবাবকে কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা চীনের অস্ত্র রপ্তানি নীতির স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম যুদ্ধক্ষেত্রে অকার্যকর প্রমাণিত হলে, তার রপ্তানিকারক দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং পণ্যের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

চীনের দ্বৈত ভূমিকা: সামরিক সহায়তা ও কূটনৈতিক আহ্বান

ঝাং জিয়াওগ্যাং কেবল অস্ত্রের কার্যকারিতাই নয়, ভারতীয় কর্মকর্তাদের আরও কিছু অভিযোগ এড়িয়ে গেছেন। অভিযোগ ছিল, সামরিক সংঘাতে চীন পাকিস্তানকে বিমান প্রতিরক্ষা এবং স্যাটেলাইট সহায়তাও প্রদান করেছে। এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখপাত্র এই অভিযোগগুলোর জবাব না দিয়ে কূটনীতির আশ্রয় নেন। তিনি বারবার চীনের ‘শান্তিপূর্ণ’ অবস্থানের কথা তুলে ধরেন এবং বলেন যে ভারত ও পাকিস্তান এমন প্রতিবেশী যাদের সরানো যায় না।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ববর্তী বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করে ঝাং বলেন:

  • “আমরা আশা করি উভয় পক্ষই শান্ত ও সংযত থাকবে এবং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে এমন পদক্ষেপ এড়িয়ে চলবে।”

৭-১০ মে-র সামরিক সংঘাতের পর চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এটি ছিল প্রথম মিডিয়া ব্রিফিং। ঝাং জানান, চীন একটি ব্যাপক ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি অর্জন এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে ইচ্ছুক। এটি একটি স্ব-বিরোধিতামূলক অবস্থান তৈরি করে, কারণ একদিকে চীন শান্তির কথা বলছে, অন্যদিকে তার ‘সর্ব-মৌসুমী মিত্র’ পাকিস্তানকে বিতর্কিত সামরিক সহায়তা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে, যা তার কথিত সামরিক সমর্থনের সাথে সাংঘর্ষিক।

আলিপুরদুয়ারের জনসভায় মোদীর বার্তা : ‘নির্মম সরকার’কে উপড়ে ফেলে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’র ডাক!

পাকিস্তান-চীনের ‘সর্ব-মৌসুমী’ সম্পর্ক এবং অস্ত্রের নির্ভরশীলতা

পাকিস্তানের দ্বারা চীনা অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ‘সর্ব-মৌসুমী’ সম্পর্কের কারণে চীনা সরকারি সংবাদমাধ্যম ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছিল। এই আগ্রহ শুধু সংঘাতের খবরের প্রতি নয়, বরং তাদের রপ্তানিকৃত অস্ত্রের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণেরও একটি সুযোগ ছিল।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট এই সম্পর্কের গভীরতা আরও স্পষ্ট করে তোলে। রিপোর্ট অনুযায়ী, চীন পাকিস্তানের বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পাকিস্তানের মোট অস্ত্র সংগ্রহের ৮১ শতাংশই এসেছে চীন থেকে। এই বিশাল পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, পাকিস্তান তার সামরিক সরঞ্জামের জন্য কতটা গভীরভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য এবং ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।

উপসংহার
 ভারত-পাক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে চীনা অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন এবং চীনের সামরিক মুখপাত্রের নীরবতা বেজিং-এর আঞ্চলিক ভূমিকা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। একদিকে ‘শান্তি ও সংযম’-এর কূটনৈতিক বার্তা, অন্যদিকে তার ঘনিষ্ঠ মিত্রকে অব্যাহত সামরিক সহায়তা – চীনের এই দ্বৈত অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হচ্ছে। এই ঘটনাগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং ভারত-চীনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের উপর কী প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর