ব্যুরো নিউজ ২২ মে : ভারতের ‘চিকেন নেক’ করিডোর (শিলিগুড়ি করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের প্রেক্ষিতে এবার ঢাকাকে সরাসরি হুঁশিয়ারি দিলেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। বুধবার (২১শে মে, ২০২৫) এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের দুটি ‘চিকেন নেক’-এর কথা, যা আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
‘এক নেক’ বনাম ‘দুই নেক’: হিমন্তের সরাসরি মন্তব্য
ভারতকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্তকারী কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর (প্রায় ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত) নিয়ে বাংলাদেশ যখন সরব, তখন হিমন্ত শর্মা সরাসরি ইঙ্গিত দেন, “আমাদের একটি চিকেন নেক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের দুটি চিকেন নেক আছে। যদি বাংলাদেশ আমাদের চিকেন নেকে আক্রমণ করে, তবে আমরা বাংলাদেশের দুটি চিকেন নেককেই আক্রমণ করব।” তিনি আরও যোগ করেন, “মেঘালয় সংলগ্ন চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে থাকা তাদের চিকেন নেক ভারতের চিকেন নেকের চেয়েও সরু এবং একেবারে হাতের নাগালে।” তার এই মন্তব্য ঢাকার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ভারতের সামরিক শক্তির স্মরণ ও ‘অপারেশন সিঁদুর’
বিজেপির এই বলিষ্ঠ নেতা বাংলাদেশকে ভারতের সামরিক শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেন, বিশেষ করে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর, যেখানে ভারত পাকিস্তানের গভীরে সন্ত্রাসী আস্তানা ধ্বংস করেছিল এবং তাদের ১১টি সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছিল। শর্মা দৃঢ়ভাবে বলেন, “ভারতকে আক্রমণ করার আগে বাংলাদেশের ১৪ বার পুনর্জন্ম নিতে হবে।”
হুঁশিয়ারি ও এর তাৎপর্য: চীনের জড়িত থাকার অভিযোগ
হিমন্ত শর্মার এই কঠোর মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই হুঁশিয়ারি এমন এক গুরুতর খবরের প্রেক্ষাপটে এসেছে যে, চীন বাংলাদেশের লালমনিরহাটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন একটি বিমান ঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করতে কথিত সাহায্য করছে। এই ঘাঁটিটি ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’ করিডোর থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শিলিগুড়ি করিডোরের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করে, এই এলাকায় চীনা উপস্থিতি ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলিকে সতর্ক করে তুলছে।
সম্প্রতি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরের সময় ভারতের ‘স্থলবেষ্টিত’ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কথা উল্লেখ করে এই অঞ্চলটির জন্য বাংলাদেশকে ‘একমাত্র সমুদ্রের রক্ষক’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। হিমন্ত শর্মার এই মন্তব্য ইউনূসের এই ধরনের বক্তব্যের সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’গুলি কোথায়?
হিমন্ত শর্মা যেমনটি সঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন, ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরের মতোই বাংলাদেশেরও দুটি ‘চিকেন নেক’ রয়েছে:
প্রথম ‘চিকেন নেক’: এটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডকে চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে। চট্টগ্রাম হলো বাংলাদেশের বৃহত্তম বন্দর শহর এবং দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯০ শতাংশেরও বেশি পরিচালনা করে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত্রিপুরার দক্ষিণ সাবরুম (ফেনি নদীর তীরে অবস্থিত) থেকে বাংলাদেশের মিরসরাই উপজেলা পর্যন্ত স্থলপথের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার, যা চট্টগ্রামকে দেশের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করে। এই সরু করিডোরটি অবরুদ্ধ করা হলে বাংলাদেশের ২০% ভূমি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং চট্টগ্রাম পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। একজন পণ্ডিত এই বিষয়ে এক্স-এ (আগের টুইটার) বলেছেন, “স্থলবেষ্টিত ত্রিপুরা এবং সমুদ্রের মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশকে ভেদ করে যায়। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর অংশ এবং এর পূর্বাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে সরু দূরত্বও।”
দ্বিতীয় ‘চিকেন নেক’: এটি রংপুর বিভাগের দক্ষিণে অবস্থিত একটি করিডোর, যা মেঘালয়ের সাথে প্রতিবেশী। মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম গারো পাহাড় থেকে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর পর্যন্ত, বাংলাদেশের রংপুর বিভাগকে মাঝখানে রেখে এই করিডোরের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার।
এই ভূখণ্ডগুলির কৌশলগত দুর্বলতা তুলে ধরে হিমন্ত শর্মার মন্তব্য আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।