ব্যুরো নিউজ ২৭ জুন: বাজাওদের এই জলজ জীবনযাত্রার কারণ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। অনুমান করা হয় যে, তারা সহস্রাধিক বছর আগে দক্ষিণ ফিলিপাইন এবং সুলু দ্বীপপুঞ্জ থেকে অভিবাসী অস্ট্রোনেশিয়ান-ভাষী সামুদ্রিক গোষ্ঠীর বংশধর। একসময় তারা বৃহত্তর সামুদ্রিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কের অংশ ছিল। কিছু নৃতাত্ত্বিক মনে করেন যে, তাদের জমি হয়তো অন্য কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছিল, বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমিতে তাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছিল, যার ফলে তারা সমুদ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বিংশ শতাব্দীতে, অনেক বাজাওকে উদ্বাস্তু হিসাবে গণ্য করা হতো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে তাদের ভূমিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি, যা তাদের সমুদ্রে জীবনযাপন চালিয়ে যেতে বাধ্য করে। তাদের এই যাযাবর জীবনযাত্রা তাদের অনন্য সংস্কৃতি গঠনে সহায়তা করেছে। এটা যেন মানবসভ্যতা বিনাশের পরবর্তী সিনেমা ‘ওয়াটার ওয়ার্ল্ড’-এর এক বাস্তব চিত্রণ!
বাসস্থান ও ভৌগোলিক অবস্থান
বাজাও জনগোষ্ঠী মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত উপকূলীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনের উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে সুলু সাগরের আশেপাশে তাদের বসবাস দেখা যায়। ঐতিহাসিকভাবে তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী নৌকা ‘লেপা-লেপা’ (lepa-lepa)-তে বসবাস করে, যা তাদের ভাসমান বাড়ি হিসেবে কাজ করে। কিছু বাজাও সম্প্রদায় যদিও এখন তীরের কাছাকাছি জলভাগের উপর খুঁটি গেড়ে নির্মিত বাড়িতে (stilt houses) বসতি স্থাপন করেছে, কিন্তু সমুদ্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আজও অটুট।
কাটা হাত জুড়ে দেওয়া হল পায়ে ? এক অভিনব চীনা চিকিৎসা !
জলজ জীবনের কারণ ও ইতিহাস
বাজাওদের এই জলজ জীবনযাত্রার কারণ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। অনুমান করা হয় যে, তারা সহস্রাধিক বছর আগে দক্ষিণ ফিলিপাইন এবং সুলু দ্বীপপুঞ্জ থেকে অভিবাসী অস্ট্রোনেশিয়ান-ভাষী সামুদ্রিক গোষ্ঠীর বংশধর। একসময় তারা বৃহত্তর সামুদ্রিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কের অংশ ছিল। কিছু নৃতাত্ত্বিক মনে করেন যে, তাদের জমি হয়তো অন্য কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছিল, বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমিতে তাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছিল, যার ফলে তারা সমুদ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বিংশ শতাব্দীতে, অনেক বাজাওকে উদ্বাস্তু হিসাবে গণ্য করা হতো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে তাদের ভূমিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি, যা তাদের সমুদ্রে জীবনযাপন চালিয়ে যেতে বাধ্য করে। তাদের এই যাযাবর জীবনযাত্রা তাদের অনন্য সংস্কৃতি গঠনে সহায়তা করেছে।
জীবনযাপন ও বিশেষ অভিযোজন
বাজাওদের জীবন সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রনির্ভর। ছোটবেলা থেকেই তারা সাঁতার কাটা ও ডুবুরি শিখতে শুরু করে। তাদের অসাধারণ ডুবুরি দক্ষতার পেছনে রয়েছে তাদের শারীরিক অভিযোজন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাধারণ মানুষের তুলনায় বাজাওদের প্লীহা (spleen) প্রায় ৫০% বড় হয়। এই বড় প্লীহা তাদের ডুব দেওয়ার সময় শরীরে আরও বেশি অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত সঞ্চয় করতে সাহায্য করে, যা তাদের দীর্ঘক্ষণ শ্বাস ধরে রাখতে এবং ৩০-৪০ মিটার গভীরে এমনকি কোনো আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়াই ডুব দিতে সক্ষম করে তোলে। এই ক্ষমতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হচ্ছে।
তাদের প্রধান জীবিকা হলো মাছ ধরা। তারা ঐতিহ্যবাহী বর্শা, হাতে তৈরি জাল এবং ফাঁদ ব্যবহার করে মাছ, অক্টোপাস, সামুদ্রিক শসা এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে। লেপা-লেপা নৌকাগুলো কেবল তাদের বাড়ি নয়, বরং তাদের যাতায়াত ও মাছ ধরার প্রধান মাধ্যম। আধুনিকতার প্রভাবে কিছু বাজাও এখন স্থায়ীভাবে ভূমিতে বসবাস শুরু করলেও, তাদের সংস্কৃতিতে সমুদ্রের প্রভাব গভীর।
সংস্কৃতি ও বিশ্বাস
বাজাওদের সংস্কৃতি সমুদ্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের বিশ্বাস ও রীতিনীতি সমুদ্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। যদিও বাজাওদের অধিকাংশই সুন্নি মুসলমান, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো তাদের দৈনন্দিন সামুদ্রিক জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। তারা ‘ওমবোহ দিলাউট’ (Omboh Dilaut) অর্থাৎ সমুদ্রের দেবতা এবং অন্যান্য সামুদ্রিক আত্মার পূজা করে। অনেক সময় তাদের উপাসনার স্থানগুলোও জলের উপর তৈরি হয়।
সামাজিক জীবন পারিবারিক জোটের উপর কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, যেখানে একাধিক পরিবার একত্রে নৌকা বা খুঁটির উপর তৈরি বাড়িতে পাশাপাশি বসবাস করে। তারা নিজেদের ‘সামা’ (Sama) বলতে পছন্দ করে, যার অর্থ তাদের নিজস্ব ভাষায় ‘আমরা’। তাদের লোককথা, সঙ্গীত, নৃত্য এবং শিল্পকর্মের মধ্যেও সমুদ্রের গভীর প্রভাব দেখা যায়।
খাদ্যাভ্যাস
বাজাওদের খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রনির্ভর। তাদের প্রধান খাবার হলো সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, অক্টোপাস, স্কুইড এবং সামুদ্রিক শসা (sea cucumbers)। তারা এই সামুদ্রিক জীবগুলো শিকার করে এবং তাজা অবস্থায় খায় বা রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে। ডাঙার জিনিসের জন্য তারা উপকূলে বসবাসকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমুদ্রজাত দ্রব্য বিনিময় করে, যেমন – চাল, কাসাভা (এক ধরনের কন্দমূল) এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল সংগ্রহ করে। ঐতিহ্যবাহী বাজাও খাবারগুলোর মধ্যে মাছ এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর স্টু বা কারি অন্যতম।
স্বাস্থ্যসেবা ও ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা
বাজাওদের স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা সীমিত, বিশেষ করে যারা সমুদ্রে যাযাবর জীবনযাপন করে। আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলো তাদের কাছে খুব কমই পৌঁছায়। এর ফলে তারা বহুলাংশে ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল। তারা সামুদ্রিক শ্যাওলা এবং বিভিন্ন স্থানীয় গাছপালা থেকে তৈরি ভেষজ ব্যবহার করে জ্বর, সর্দি, পেটের পীড়া এবং অন্যান্য অসুস্থতার চিকিৎসা করে। কিছু বাজাও সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, তাদের অসুস্থতার কারণ হল অশুভ আত্মার প্রভাব, তাই তারা নিরাময়ের জন্য কিছু নিরাময় আচার-অনুষ্ঠানও পালন করে।
খিলক্ষেতে দুর্গামন্দির ভাঙল ইউনূস প্রশাসন: হিন্দুদের উপর আক্রমণের নতুন দৃষ্টান্ত
উপসংহার
বর্তমানে, অনেক বাজাও সম্প্রদায়ের মানুষ নাগরিকত্ব এবং মৌলিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুবিধার অভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা তাদের আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করার চেষ্টা করছে, তবে এই প্রক্রিয়াটি তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং জীবনযাত্রার সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তা সত্ত্বেও, বাজাও জাতি তাদের অনন্য ঐতিহ্য এবং সমুদ্রের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক বজায় রেখে আজও টিকে আছে, যা বিশ্বজুড়ে মানুষকে মুগ্ধ করে চলেছে। এর সাথে বাজাওদের ইতিহাস থেকে এক উল্লেখযোগ্য শিক্ষা – যে নিজের ভিটা মাটি থেকে উদ্বাস্তু হলে সংরক্ষণ দেওয়ার মতন সমাজ খুব কম – হয়ত স্থল ছেড়ে জলেই তৈরি হবে সংসার এবং সংস্কার ! তাই নিজ ভূমী , নিজ সংস্কৃতি এবং বাসদস্থানের জন্যে লড়াইয়ের অধিকার সবার , জনবিন্যাসে পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায়ীত্বও সবার ।